প্যারিস চুক্তির আওতায় জলবায়ু অর্থায়নে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য দূষণকারীর ক্ষতিপূরণ প্রদান নীতি বিবেচনা করে ঋণের পরিবর্তে প্রতিশ্রুত উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘নতুন’ অর্থ সরকারি অনুদান হিসেবে প্রদান নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে টিআইবি।
জিসিএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিল হতে প্রয়োজনীয় তহবিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাসময়ে ও সহজে সরবরাহ, ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সমন্বিতভাবে (ক্লাইমেট ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে) দাবি উপস্থাপন ও দর কষাকষিতে দক্ষতা প্রদর্শন করাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ‘ক্ষয়-ক্ষতি’ মোকাবেলায় “ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম”-এর চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে মেকানিজমটি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং শুদ্ধাচার নিশ্চিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল তথা সরকারের নিকট আসন্ন কপ-২৫ এ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তাব প্রদান করে টিআইবি।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরেছে।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আসন্ন কপ-২৫ সম্মেলনে প্যারিস চুক্তিতে সাক্ষরকারী দেশসমূহ তাদের অঙ্গীকারকৃত জলবায়ু অর্থায়নের পাশাপাশি ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজমের আওতায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় ক্ষতিপূরণ প্রদান, ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রযোজ্য নীতিমালা ও কর্ম পদ্ধতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচিত হবে।
জলবায়ু অর্থায়নকে সম্পুর্ণ আলাদা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অর্থায়ন হতে হবে উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ ও ‘নতুন’ এবং এটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে আসতে হবে। যদিও দূষণকারী দেশসমূহ প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে যে ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর তারা ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে অথচ এক্ষেত্রে কোনো ধরণের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নের জন্য প্রদত্ত অঙ্গীকারের বিপরীতে বিভিন্ন ধরণের দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থ প্রাপ্তির জন্য নতুন ধরণের শর্ত যেমন বীমা ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে নতুন ধরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত করছে।
ড. জামান বলেন, টিআইবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধিপরামর্শ কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশ সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) থেকে মাত্র ৮৫ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার অনুমোদন পেয়েছে, যে অর্থ এখনও ছাড় করা হয়নি। জলবায়ু অর্থায়নের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকে মাত্র ৩৫০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতীয় বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপকে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণের চেয়ে আমাদের জাতীয়ভাবে বরাদ্দ ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণ বেশি যা একদিক থেকে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো- ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন অনুসারে শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভিযোজন বাবদ বছরে যেখানে ২.৫ বিলিয়ন ডলার দরকার সেখানে প্রয়োজনীয় অর্থ আমরা আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাচ্ছিনা।
পাশাপাশি, অর্থায়ন বিরোধী একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে যা অন্যান্য দেশসমূহে জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে ভুল বার্তা প্রদান করছে।
এছাড়া, জিসিএফ নির্ধারিত কঠিন মানদণ্ড নিশ্চিত করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে সক্ষম না হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ক্রমেই জিসিএফএ নিবন্ধিত হচ্ছে।
এমন প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু তহবিলকে লাভজনক বিনিয়োগ বা ব্যবসার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে যা অনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির লংঘন। এছাড়া দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এবং শুদ্ধাচারের ঘাটতি রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে জিসিএফ এর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
এ বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ করে তিনি কপ২৫ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশের মত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সাথে যৌথ ও এককভাবে ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে সম্মেলনে উপস্থাপনের অনুরোধ করেন।
ড. জামান আরো বলেন, জিসিএফ-এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে জিসিএফ কর্তৃক অর্থ প্রদানের পদ্ধতিসমূহ বাংলাদেশের মত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি বাবদ ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য কোনো নির্দেশনা বা তহবিল এখনও গঠিত হয়নি।
প্যারিস চুক্তি আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ প্রদত্ত অঙ্গীকার এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জলবায়ু অর্থায়নের ব্যাপারে যারা অঙ্গীকার করেছেন তাদের ব্যর্থতার বিষয়গুলো সরকারকে সোচ্চারভাবে তুলে ধরতে হবে।
একইসাথে নিজেদের নৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সরকারের নিজের ভূমিকাকেও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর বাংলাদেশের মাদকীয় নির্ভরতা সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে বাংলাদেশ সরে আসতে পারেনি, বরং বেড়ে চলেছে। এর ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ নিজেকে দূষণকারী দেশ হিসেবে রূপান্তরিত করছে।
অথচ বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের চাহিদার ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হবে এবং যার সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসছে।
সুন্দরবনসহ উপকূলীয় অঞ্চলের এবং পরিবেশের ক্ষতি না করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে গুরূত্বারোপ করে ড. জামান বলেন, অনতিবিলম্বে রামপাল, তালতলি ও কলাপাড়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে ইউনেস্কো’র সুপারিশ অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব-মুক্ত কৌশলগত পরিবেশের প্রভাব নিরুপণ সাপেক্ষে অগ্রসর হতে হবে। একই সাথে, এই ধরণের পরিবেশ জনিত প্রভাব নিরূপণ যেন স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
টিআইবি’র পক্ষ থেকে উপস্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে আরো আছে: উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে চাহিদা মাফিক জলবায়ু অনুদান ভিত্তিক তহবিল প্রদানে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলো থেকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সম্পদ সরবরাহের জোর দাবি উত্থাপন করা, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে সমতা-ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক এবং কার্যকর ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা, এবং ‘ক্ষয়-ক্ষতি’ মোকাবেলায় একটি জাতীয় কাঠামো প্রণয়নসহ বিপন্ন মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলা প্রভৃতি।
উল্লেখ্য, জলবায়ু অর্থায়ন এবং তার ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে টিআইবি ২০১১ সাল হতে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অংশীজনের সাথে গবেষণা-ভিত্তিক সুপারিশ বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ফলে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার-ক্লাইমেট ফিন্যান্স গর্ভনেন্স এম. জাকির হোসেন খান এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার-ক্লাইমেট ফিন্যান্স পলিসি ইন্টেগ্রিটি মো: মাহফুজুল হক উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে এম. জাকির হোসেন খান ও মো: মাহফুজুল হক বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নে অনিশ্চয়তা সহ সব ইস্যুতে প্রত্যাশা উপস্থাপন করেন।
দেখুন লাল সবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ ।
আরও পড়ুন : স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিস্কার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনার প্রস্তাব
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা