পর্ব - ১
আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে যাব তখন আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। এমতাবস্থায় আমরা সেইসময়ে বাংলাদেশের যে রাজনীতি, যে উত্তাল গণজোয়ার এর সাথে ছাত্র হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলাম। এক সময়ে ৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করল। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল যে, আওয়ামীলীগের কাছে পাকিস্তানের স্বৈর শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন না। সেই কারণে মোটামুটি একটা রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হলো। এই বিরোধটা আমরা আমাদের দৃষ্টিতে যেটি ছাত্র হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছি। এই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ইয়াহিয়া খানসহ , টিক্কাখানসহ এবং যারা সেই সময়ের ভূট্টো সাহেব, যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিল, তার সাথে রাজনৈতিক কলা কৌশলের বৈঠক বঙ্গবন্ধু শেখু মুজিবুর রহমানের সাথে হতে থাকে। আমরা তখনও যদিও সাতই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ – তখনই আমরা একটু আন্দাজ করেছিলাম যে দেশটা হয়ত সে পথেই এগুবে। কিন্তু তখন আমরা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে অতটা ম্যাচিউরড ছিলাম না, অতটুকু পাকা ছিলাম না, যে কারণে উপলব্ধিবোধের জায়গা একটু ভাসা ভাসা অবস্থান আমাদের ছিল।
কিন্তু মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন এই আবহাওয়াটা ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হতে থাকল তখন তার আঁচড় আমাদের গায়ে এসে লাগল। তখন আমাদের কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। আমরা তখন ফিরে গেলাম আমাদের নিজ নিজ বাড়িতে। আমার ফাদার তখন চাকরি করতেন পাবনা জেলার ভাঙুরা পোস্ট অফিসে। পোস্ট মাস্টার ছিলেন। আমি ফ্যামিলিতে ফিরে গেলাম। ফিরে যাবার পরে আমার ছোট দুটো ভাইবোন তখন সবেমাত্র তারা লেখাপড়া করে। শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত ছিল তখন। আমার বড় বোনের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। সেই সময়ে এই অবস্থা থাকার মধ্য দিয়ে যখন মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে, যেহেতু আমি পাবনায় ছিলাম ২৩শে মার্চের দিকে আমরা বড়াল ব্রিজের যে রেললাইন ছিল সেই রেললাইন আমরা ছাত্ররা এবং রেলের কর্মীদের সাথে করে নিয়ে আমরা রেলের স্লিপার দুইটা উপড়ে ফেলে দিলাম নিচে। যাতে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। তখনও বুঝি নাই যে যুদ্ধটা শুরু হবে। এর আগেই আমরা অচল করে দেয়ার জন্য ঐ যে বলেছিল তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল, আমরা সেই প্রতিরােধ গড়ে তোলার জন্য ছাত্ররা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাত আটটা নয়টা থেকে শুরু করে রাত তিনটা পর্যন্ত আমরা এই অভিযান চালিয়ে এটা করলাম। পরে, ২৩ শে মার্চেই তখন পাকিস্তান দিবস ছিল। আমরা আইয়ূব খানের ভাষণ ছিল, সেই ভাষণ শুনেই আমরা বুঝতে পারলাম যে এইটা আর ফেরা সম্ভব নয়। এরমধ্যেই তো ২৫ শে মার্চের হামলা শুরু হয়ে গেল এবং মার্চ মাসের ২৭ তারিখের দিকে প্রথম পাবনা শহরে খানসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। তখন মুক্তিবাহিনী কিন্তু ঐভাবে সংগঠিত না।
তখন আমি ভাঙুরাতে অবস্থান করছি। এরমধ্যে ভাঙুরাতে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো। সেই সংগ্রাম কমিটির যিনি চেয়ারম্যান হলেন, আমার বাড়ির পাশেই একটা ঘরে সংগ্রাম কমিটির অফিস তৈরি হলাে। বিভিন্ন জায়গা থেকে যার যার দোনলা একনলা বন্দুক ছিল সেগুলো সংগ্রহ করা হলো। তারপর দোনলা-একনলা বন্দুক দিয়ে যে যুদ্ধ করা যায়না সেটা সবাই উপলব্ধি করতে পারছিল তবু আপাতত আত্মরক্ষামূলক অবস্থান সৃষ্টি করার জন্য এটা রাখা হলো। তারপরে, দেখা গেল যে, বড়াল ব্রিজের কাছেই বিশাল পাটের গোডাউন ছিল। সেখানে আটজন আনসার ছিল। তারা পাহারা দিত। তাদের কাছে থ্রিনট থ্রি রাইফেল ছিল। আমরা সেই রাইফেলগুলো নিয়ে নিলাম সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে। নিয়ে আমার বাসার পাশেই সংগ্রাম কমিটির অফিস। এখন এই অস্ত্র আর এই অফিস সার্বক্ষণিক অফিস কে পাহারা দিবে এই নিয়ে সংগ্রাম কমিটির মধ্যে আলোচনা হলো। কারণ সবার তো শহরে বাড়ি না। একদম প্রোপারে বাড়ি না। তখন যেহেতু আমার ঘরের পাশেই অফিস, তাই আমাকে বলা হলো তুমি এই দায়িত্বটা পালন করো। এরমধ্যে পাবনাতে ২৭শে এপ্রিলের দিকে ৬০-৭০ জনের একটা মিলিটারি গ্রুপ ঢুকে পড়ে। তারা পাবনার যে টেলিগ্রাম অফিস সেখানে ১৬-২০ জন আর বাকিগুলো পাবনার বিসিক এবং ডাকবাংলায় আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নিয়ে তারা সেদিন সেখানে কারফিউ জারি করে। কারফিউ জারি করার মধ্য দিয়ে পরেরদিন লোকজন যেই বের হয়েছে। তখন একজন ফকিরসহ দুজন পথচারিকে তারা গুলি করে মারে। এই মারার মধ্য দিয়েই পাবনার মানুষ উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
তখন পাবনার শহর ছেড়ে যে গ্রামাঞ্চলের যে চর ছিল, সেখানে প্রগতিশীল রাজনীতির একটি ধারা ছিল এবং আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ এর একটি ধারা ছিল। তারা পুরোপুরি সংগঠিত ছিল। তখন এই মৃত্যুর প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে লাঠি সোঠা নিয়ে তারা শহরকে ঘিরে ফেলল। ঘিরে ফেলে তখন তারা কি করল পাবনার কাছেই ছিল বাণী সিনেমা হল। বাণী সিনেমা হলের কাছে এক গ্রুপ, আর এক গ্রুপ সেখানের ঐতিহাসিক তাড়াশ ভবন, যেটি একটি জমিদার বাড়ি ছিল, জমিদার খান বাহাদুরের বাড়ি ছিল। এই খান বাহাদুরের কাছারি বাড়িটিই ছিল টেলিগ্রাম অফিস। তখন তারা কি করল এইখান থেকে তারা পাবনা পুলিশ লাইন থেকে রাইফেলসহ সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিল তারা, এই জনতা এবং ছাত্রলীগ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। নিয়ে এসে তাদেরকে ঘেরাও করে বানী সিনেমা হল থেকে গুলি চালাতে শুরু করল ওদিকে তাড়াশ ভবন থেকে গুলি শুরু করল। গুলি শুরু করার আগ পর্যন্ত, সকাল থেকে শুরু ১২ টা ১ টার দিকে এলেঙ্গা অফিসের যে মিলিটারিরা ছিল তারা হতভম্ব হয়ে গেল এত গুলি দেখে এবং মুর্হুমূহু গুলি আর শ্লোগানে তারা ভীত হয়ে সারেন্ডার করল।
আর দু্ই একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়ে ছিলই। যেই সারেন্ডার করল তখন এই যে বিক্ষুব্ধ মানুষগুলো তাদেরকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে, নানাভাবে পিটিয়ে তাদেরকে হত্যা করল। এই হত্যার খবর যখন ওয়্যারলেসে বিভিন্ন যায়গায় খবর হয়ে গেল, তখন বিসিক এবং ডাকবাংলায় যে সেনাবাহিনীর গ্রুপগুলো ছিল তারা পিছু হটে শহর ছেড়ে ঈশ্বরদী পাকশী দিয়ে তাদের সেই যেখান থেকে এসেছিল সেই নাটোরের দিকে, রাজশাহীর দিকে তারা মুভ করল। মুভ করল এদিকে তাদেরকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য বিমান আসল। পাবনার উপরে কয়েকটা চক্কর দিল। গুলিবর্ষণ করল। তখন মানুষ ভীত সন্তস্ত্র হয়ে শহর ছেড়ে সবাই গ্রামের দিকে পালাতে থাকল। আর যে মিলিটারিরা পিছু হটে যাত্রা শুরু করল রাজশাহীর দিকে তারাও পর্যায়ক্রমে রাস্তায় সাধারণ মানুষের হাতে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা ঐই সময়ে যেভাবে পারুক তাদেরকে হত্যা করল। সেনাবাহিনীর কোন লোকই ফেরত যেতে পারেনি সেই সময়।
এরপরেই তখন তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করল। আর পাবনায় যেদিন মিলিটারিরা ফল করল তখন প্লেন উড়ার পরেই যেহেতু পাবনা শহর থেকেই মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রামে চলে গেল ভয়ে। এরমধ্যে আমরা ইফেক্টিভ হলাম এই ভাবে যখন পাবনায় দেখা গেল সিভিল সার্জন এবং এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিল সিরাজগঞ্জের মানুষ। তারা তাদের সবুজ রংয়ের জীপ নিয়ে এই রাস্তায় আসা শুরু করল, বড়াল ব্রিজের দিকে। নৌপথে তারা গ্রামে ফিরে যাবে। যেহেতু রেললাইন চলছে না। অন্য কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন উন্নততর ছিল না। তখন ঐ সবুজ গাড়ি আসছে সবাই মনে করছে পাক বাহিনী আসছে। তখন ঐ আটঘরিয়া চাটমোহর, ভাঙুরার যে রাস্তাটা আছে সবলোক ভয়ে পালাচ্ছে। কেউ গাছের গুঁড়ি ফেলেছিল তারা সেগুলোকে আবার সরিয়ে সরিয়ে যাচ্ছে। তখন আমাদের বাসাটা ছিল ঠিক বড়াল নদীর পার্শ্বেই।
# আবুল বাশার, ভাইস প্রেসিডেন্ট, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।
# সিনিয়র স্টাফ রিপাের্টার।
দ্বিতীয় পর্ব মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে।
আরও পড়ুন : আসলে একাত্তর সালের সময়টা মুখের কথায় বর্ণনা করা অত্যন্ত কঠিন : কামাল আহমেদ
লালসবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা