চট্টগ্রামে শনিবার তিনটি ক্লাবে একযোগে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ অভিযান শুরু হয়। ক্লাব তিনটি হল- নগরীর সদরঘাটে অবস্থিত মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আইসফ্যাক্টরি রোডে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ক্লাব এবং হালিশহরে অবস্থিত আবাহনী ক্লাব।
ক্লাবগুলো থেকে তাস, জুয়ার বোর্ডসহ বিভিন্ন সামগ্রী জব্দ করা হয়। র্যাবের তিনটি বিশেষ টিমের চালানো এ অভিযানে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা যায়নি। অভিযানের খবর আগেই পেয়ে টেবিলে জুয়ার সামগ্রী ফেলেই জুয়াড়িরা সরে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে প্রতিটি ক্লাবে প্রতি রাতে জুয়ায় লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে র্যাব। এর মধ্যে শনিবার রাতেই মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ক্লাবে ১২ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে র্যাব। দুটি ধারালো অস্ত্রও পাওয়া যায় এ ক্লাবে।
র্যাবের এএসপি তারেক আজিজ বলেন, আমাদের তিনটি টিম একযোগে অভিযান শুরু করে। রমরমা জুয়া চলে এমন তিন ক্লাবেই অভিযান চলছে। অভিযানে জুয়ার সামগ্রী পাওয়া গেছে।
র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে জুয়াড়িরা আগেভাগেই সরে পড়েছে বলে ধারণা করছি। র্যাব সূত্র জানায়, এসব ক্লাব কারা চালায়, ক্লাবে জুয়ার বৈধতা আছে কিনা, প্রতিটি ক্লাবে জুয়া খেলায় কী পরিমাণ লেনদেন হয়- এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চট্টগ্রামের শুধু অভিজাত ক্লাব-রেস্টুরেন্ট কিংবা বারে নয়, নগরজুড়ে শতাধিক স্পটে বসে জুয়ার বোর্ড। এসব জুয়ার বোর্ডে নিম্ন আয়ের মানুষ সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন।
দৈনিক কয়েক কোটি টাকা এসব জুয়ার আসরে হাতবদল হয়। অভিযোগ রয়েছে- স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই এসব জুয়ার বোর্ড পরিচালিত হয়।
রাজধানী ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযানের পরপরই চট্টগ্রামের বেশিরভাগ জুয়ার আসর ও বারের কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট জুয়ার বোর্ড এখনও বিদ্যমান।
জানা গেছে, এসব আসরে টাকার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণের গহনা, মোবাইল সেট এমনকি মোটরসাইকেলও জমা রেখে জুয়া খেলা হয়। জুয়ার আসরে সুদে টাকা লাগানোর ব্যবসায়ও লিপ্ত আছে অনেকে।
তারা স্ট্যান্ডবাই থাকে। চলে মাদকের বেচাকেনাও। এসব জুয়ার বোর্ডে মুষ্টিমেয় লোক লাভবান হলেও বেশিরভাগই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- ক্লাবঘর, গোডাউন ও পার্টি অফিসের নামে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জুয়ার বোর্ড বসানো হয়। আইপিএল ও বিপিএল ক্রিকেট এলে তো কথাই নেই।
সবচেয়ে বেশি জুয়া চলে এসব খেলা চলাকালীন। জুয়ার সঙ্গে জড়িতরা বলেছেন, ম্যাচের পাওয়ার প্লেতে কত রান হবে, ৫ বা ১০ ওভারে কত রান হবে, কোন বলে ছক্কা হবে, কে কত উইকেট পাবে, কিংবা খেলায় কোন দল জিতবে এসব নিয়ে হাজার টাকা থেকে লাখ টাকার বাজি ধরেন জুয়াড়িরা।
বাকলিয়া এলাকায় রিকশাচালক, টেক্সিচালক থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া দিনমজুররাও এমন জুয়ায় মেতে ওঠেন। বাস-ট্রাক শ্রমিকরাও থেমে নেই।
বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত এসব জুয়ার আসরে দৈনিক ৩-৪ কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে ঢাকায় ক্যাসিনো মালিদের হাতকড়া পরানোর পর দু-একদিন ধরে এসব জুয়ার বোর্ডেও আতঙ্ক চলছে।
ফকিরহাটের বাসিন্দা সুলতান আহমেদ চট্টগ্রাম নগরীতে বেশ কয়েকটি জুয়ার আসর পরিচালনা করেন। এর মধ্যে পাহাড়তলী থানার আলিফ গলি, পাহাড়তলী থানা এলাকার সোলজার ক্লাব, প্রিপোর্ট ও বাকলিয়া এলাকায় একাধিক জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করেন সুলতান।
আগ্রাবাদ সাউথল্যান্ড সেন্টার এলাকায় একটি, দেওয়ান হাটা এলাকায় দুটি জুয়ার বোর্ড পরিচালনা করেন জাহাঙ্গীর আলম। এসব আসর ২৪ ঘণ্টাই চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব জুয়ার আসর পরিচালনায় নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্তরে। জুয়ার বোর্ড পরিচালনার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে শনিবার সুলতান আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
সিএমপির তথ্যানুযায়ী, নগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকায় একটি, সদরঘাট থানায় তিনটি, চান্দগাঁও থানায় তিনটি, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় একটি, ডবলমুরিংয়ে একটি, হালিশহরে সাতটি, পাহাড়তলীতে চারটি, পতেঙ্গায় দুটি, কর্ণফুলীতে একটি, ইপিজেডে ছয়টি ও বন্দরে তিনটি জুয়ার আসর রয়েছে।
এ ছাড়াও নগরীতে অনেক ক্লাব রয়েছে যারা প্রতিদিন জুয়ার বোর্ড থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকে। নগরীর কয়েকটি অভিজাত এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের নির্দিষ্ট কক্ষেও জুয়ার আসর বসে।
সূত্র আরও জানায়, সন্ধ্যা নামলেই সরগরম হয় জুয়ার আসরগুলো। রাত যত গভীর হয় তত উপস্থিতি বাড়ে। নগরীর একে খান মোড় এলাকায় একটি ভবনের তিন তলা ও চার তলা ভাড়া নিয়ে সৈনিক ক্লাব নাম দিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয়।
প্রতিদিন শতাধিক লোক সেখানে জুয়া খেলে ও মাদক গ্রহণ করে। বায়েজিদ বোস্তামী থানার আমিন কলোনির আশপাশে অন্তত ছয়টি স্থানে জুয়ার আসর বসে।
আমিন কলোনি বেলতলা এলাকা, আমিন কলোনির মাঠ এলাকা, টেক্সটাইল জিএম বাংলো পাহাড়ের ওপর, রউফাবাদ লেভেল ক্রসিং এলাকা, স্টারশিপ গলি, শান্তিনগর কলোনিতে জুয়ার আসর বসে বলেও স্থানীয়রা তথ্য দিয়েছেন।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) আমেনা বেগম বলেন, নগরীর সবক’টি জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জুয়া ও বার পরিচালনাকারীদের রক্ষা নেই। তারা যতই শক্তিশালী বা প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
বগুড়া টাউন ক্লাবের সম্পাদকসহ ১৫ জন গ্রেফতার
বগুড়া ব্যুরো জানায়, শনিবার রাতে শহরের ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামালসহ ১৫ জুয়াড়িকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
এ সময় তাদের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা ও জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। অভিযান শেষে রাত সাড়ে ৯টায় ক্লাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) রেজাউল করিম রেজা ও এসআই রহিম উদ্দিন জানান, শহরের সাতমাথায় টাউন ক্লাবে জুয়া খেলা চলছে। গোপনে এমন খবর পেয়ে রাতে ৯টার দিকে ক্লাবে অভিযান চালানো হয়।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জুয়াড়িরা পালানোর চেষ্টা করে। সেখান থেকে জুয়ার সরঞ্জাম ও নগদ ১ হাজার ৬০০ টাকাসহ ১৪ জুয়াড়িকে গ্রেফতার করা হয়। জুয়া পরিচালনার অভিযোগে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামালকেও গ্রেফতার করা হয়।
তবে পুলিশের অভিযান টের পেয়ে অনেক রাঘববোয়াল টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা স্থানীয়দের। এ অভিযানের পরপর জুয়াড়িদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
কেউ কেউ মন্তব্য করেন, পুলিশ ছিঁচকে অভিযান চালিয়েছে। শহরের অভিজাত জলেশ্বরীতলা, রহমাননগর, সেউজগাড়ি, কাটনারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি ক্লাব ও বাড়িতে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অবাধে জুয়া চলে। কিন্তু পুলিশ সেখানে অভিযান চালাতে পারে না।
কয়েকজন জানান, ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত টাউন ক্লাব আগে খেলোয়াড় তৈরি হতো। বড় কালুর মতো কৃতী ফুটবলারও এ ক্লাবের তৈরি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ক্লাবে কোনো খেলাধুলা হয় না।
সেখানে অবাধে জুয়ার আসর বসে। এখানে তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত জুয়া খেলতে আসে।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাসে বলেছেন, এ টাউন ক্লাব আগে ছিল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। এখন হয়েছে জুয়ার আসর।
তিনি বলেন, আমরা চাই ক্লাবগুলো আবার খেলোয়াড়দের কলকাকলিতে ভরে উঠুক। আবার তৈরি হোক নতুন নতুন খেলোয়াড়।
সূত্র: যুগান্তর।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা