ফজলুল বারী : রবিবার হাইকোর্টে আবার খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি ছিলো। এর আগে আপিল বিভাগে প্রত্যাখ্যাত জামিন যে এই হাইকোর্টে চটজলদি হবেনা তা মোটামুটি সবাই জানতেন। কিন্তু বিএনপির কুশীলব নেতারা এরপরও কথামালার রাজনীতিতে হাইকোর্টের ওপর একধরনের চাপ বহাল রেখেছিলেন! বলেছিলেন জামিন না হলে তারা চুপচাপ থাকবেননা! জামিন শুনানি শুরুর আগে হাইকোর্টের সামনে এক সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন ‘আশা করবো জামিন দিয়ে বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে’! মোটামুটি কথাটা এমন, তালগাছটা আমার! খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া মানে বিচার বিভাগ স্বাধীন, জামিন না দেয়া মানে বিচার বিভাগ পরাধীন! এর আগে মির্জা ফখরুল বলেছেন একই রকম মামলায় নাজমুল হুদা, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জামিনে আছেন। এরা কিন্তু সুবিধামতো হুদা-মায়ার সঙ্গে খালেদা জিয়াকে তুলনা করেন! অন্য সময় হুদা-মায়ার সঙ্গে খালেদা জিয়ার তুলনা করতে গেলে রাগই করতেন। মারতে তেড়েও আসতেন হয়তো।
এরপর একজন মিডিয়া কর্মী হিসাবে রোববার কিন্তু জামিন শুনানির নিউজটি অনুসরন করছিলাম। বিদেশে আমরা যারা থাকি দেশটাকেতো সারাক্ষন ফলো-অনুসরন করি অনলাইনে, টিভি চ্যানেলের পর্দায়। এর আগে সুপ্রিমকোর্ট জামিন প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে একটি পর্যবেক্ষন দিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল খালেদার সম্মতি সাপেক্ষে এডভান্স ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করার জন্যে! এই এডভান্স ট্রিটমেন্ট’এর ব্যাখ্যা সেই থেকে একেকজন জন একেক রকম ভাবে দিচ্ছেন! খালেদার আইনজীবীরা বলছেন, এই এডভান্স ট্রিটমেন্ট মানেই হলো বিদেশে চিকিৎসা! রবিবারের শুনানির পর এ নিয়ে এক মিডিয়া একেকভাবে রিপোর্ট করেছে! কেউ লিখেছে এডভান্স থেরাপি, কেউ লিখেছে এডভান্স ট্রিটমেন্ট! আদালত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আগামী বুধবারের মধ্যে জানাতে বলেছে আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে এডভান্স থেরাপিতে বেগম জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কীনা, দিলে সেই চিকিৎসা সেই শুরু হয়েছে কীনা, চিকিৎসা শুরু হলে এখন তাঁর কী অবস্থা এই তিন সুনির্দিষ্ট তথ্য বুধবারের মধ্যে আদালতকে জানাতে হবে।
আমি একজন কেয়ারার হিসাবে আর্থাইটিজের এক রোগীর দেখভাল করি। এরজন্যে এই চিকিৎসা পদ্ধতির নানান খুঁটিনাটি মুখস্ত। এর আগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন খালেদা জিয়া চিকিৎসায় তাদেরকে সহযোগিতা করছেননা। তারা রাউন্ডে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার কেবিনের বাইরে গিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনুমতির অভাবে সব সময় তাঁকে দেখার সুযোগ পাননা। এর আগে বেগম জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে তাঁর বোনকে কোন চিকিৎসাই দেয়া হচ্ছেনা। ওই বক্তব্যের উত্তরে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়েই ওই সংবাদ সম্মেলন করেন। সাধারন বিবেচনায় চিকিৎসকরা বেগম জিয়াকে চিকিৎসা দেবেননা, এমন অভিযোগ অবিশ্বাস্য। গত বছরের এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ভিভিআইপি কেবিনে বেগম জিয়ার পিছনে রাষ্ট্রের কত খরচ হয়েছে তা হয়তো একদিন জানা যাবে। কিন্তু একজন রোগিনী যদি চিকিৎসকদের সহায়তা না করেন, ডাক্তারদের ওপর ডাক্তারি করেন, তাকে চিকিৎসা দেয়া কঠিন।
খালেদা জিয়া আবার ডায়াবেটিকসের রোগিনী। যার ডায়াবেটিকস থাকে তার সব চিকিৎসাই কঠিন। ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনে রাখতে তিনি চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলেন কিনা তা চিকিৎসকরাই বলতে পারবেন। বাংলাদেশের গ্রামের লোকজনের কাছে যেটি বাতের ব্যথার সমস্যা সেটিই আর্থাইটিজ। এটি মূলত হাড়ের ক্ষয়রোগ। বয়স ও জীবন যাপনের নানা সমস্যা থেকে এই রোগটি হতে পারে। বাংলাদেশের গৃহস্থালীর কাজকর্মের জন্যে বাসা বাড়িতে লোক রাখা হয়। বিদেশে এর সুযোগ নেই। সে কারনে বাংলাদেশের লোকজন বিদেশে গিয়ে অনভ্যস্ত গৃহস্থালীর কাজকর্ম করতে গিয়েও আর্থাইটিজের সমস্যায় আক্রান্ত হন। অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তারদের কাছে ব্যথা-বেদনার সমস্যা নিয়ে গেলে প্রথম তারা জানতে চান কোন কারনে তার মন খারাপ কীনা, কোন কারনে তার ঘুম কম হয় কীনা!
এ সমস্যাগুলো খালেদা জিয়ার আছে। প্রথমে পেইন কিলার দিয়ে আর্থাইটিজের চিকিৎসা শুরু হয়। তাতে সমস্যার সুরাহা না হলে চেষ্টা করা হয় ইনজেকশনের মাধ্যমে। হাড়ের ওপর দেয়া হয় বলে এই ইনজেকশন অনেক কষ্টের। ব্যথার জায়গাটা চিহ্নিত করতে অনেক সময় রোগীকে স্ক্যানার মেশিনের ভিতর শুইয়ে জায়গাটা চিহ্নিত করে সেখানে ইনজেকশন দেয়া হয়। ব্যথার কারনে খালেদা জিয়া ইনজেকশনও নিতে চাইছেননা। ইনজেকশন ছাড়াও ফিজিও থেরাপির মাধ্যমেও চেষ্টা করা হয় ব্যথা নিরাময়ের। সব শেষে করা হয় অস্ত্রোপচার। এর সবগুলো চিকিৎসা পদ্ধতিই খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়ে গেছে। এখন তাঁর বয়সে থেরাপি সহ চিকিৎসা ম্যানেজমেন্টেই নিবিড় পর্যবেক্ষনে থাকা তার মূল চিকিৎসা। তিনি চিকিৎসকদের সহায়তা না করলে এর সুরাহা মুশকিল। কিছুদিন আগে বিএনপির সংগঠন ড্যাবের এক নেতা এক টিভিতে বলছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের চিকিৎসক! এরজন্যে নাকি বেগম জিয়া তাদের চিকিৎসা নিতে চাননা! এটি সত্য হয়ে থাকলে বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার কোন চিকিৎসা নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা কারাগারে একজন দন্ডিত হিসাবে আছেন খালেদা জিয়া।
রবিবার হাইকোর্টের আদেশের পর টিভি চ্যানেলগুলোয় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের হাসিখুশি মুখই দেখা গেলো! এমনভাবে তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন যাতে তাদের চেহারা ভালো দেখা যায়। ‘খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ’, ‘তিনি শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন’, ‘যে কোন সময় তাঁর যে কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে’ এই বক্তব্যগুলো এই হাসিখুশি চেহারাগুলোর সঙ্গে মিল ছিলোনা। খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নাল আবেদন যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছিলেন যেন হাইকোর্ট জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়নি, এটাই রবিবারের সাফল্য! এখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রিপোর্টের অপেক্ষা সবার। ওই রিপোর্টে আবার জানা যাবে খালেদা জিয়া চিকিৎসকদের সহায়তা করছেন কীনা? না এখনও চিকিৎসকদের আওয়ামী লীগের চিকিৎসক মনে করে তাদের চিকিৎসা নিচ্ছেননা! বিভিন্ন লেখায় লিখেছি আজ খালেদা জিয়া জেলের বাইরে এলে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর অবস্থার উন্নতি হবে। কারন তখন তাঁর মন ভালো থাকবে। কিন্তু মুক্তি পেতে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গেই সমঝোতা করতে হবে খালেদা জিয়াকে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা