অনলাইন ডেস্ক
নববর্ষ মানেই সকলের মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পেছনে ফেলে নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়া। স্বভাবতই নতুন বছর নিয়ে এবার মানুষের প্রত্যাশা একটি করোনা মুক্ত বিশ্ব। তবে, করোনার টিকা ছাড়াও অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনাসহ মানবসম্পদ তৈরির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হচ্ছে আগামী বছরের মোটা দাগের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, এটাই নতুন ইংরেজি বছরে সবার প্রত্যাশা।
সারা পৃথিবীতেই ২০২০ সাল, বিষাদের বছর হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে। অভিশপ্ত এ বছরটিকে বিদায় দেওয়ার জন্য সবাই যেন উন্মুখ হয়েই ছিল। অনেকেই মনে করেন, জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত ১০০ বছরেও তা দেখা যায়নি। কোভিড-১৯-এর আগের বিশ্ব আর পরের বিশ্বেও মধ্যে মিল কোন দিনই হবে না।
অনেকে এ বছরটিকে একটি বিধ্বংসী বছর বলে উল্লেখ করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারিতে লাখ লাখ মানুষ এরই মধ্যে মারা গেছেন। সেই সঙ্গে কয়েক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং অর্থনৈতিক খাতে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ১০০ কোটির বেশি শিশু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ১২ হাজার ৪৯৬ জন এবং মৃত্যু বরন করেছেন ৭ হাজার ৫৩১ জন।
চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ক্রমেই মহামারি আকারে সংক্রমণ বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানায় সরকার। পরে করোনা মোকাবেলায় মার্চের ২৬ তারিখ থেকে মে এর ৩০ তারিখ পর্যন্ত দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
তবে, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অনেক দেশের তুলনায় ভালো। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অত্যন্ত সফলতার সাথে মোকাবিলা করছেন ব্লুমবার্গ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তা প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় উপমহাদেশে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে এবং সমগ্র বিশ্বে করোনা মোকাবিলার দক্ষতায় বাংলাদেশ ২০তম স্থানে রয়েছে।
আসলে ২০২০ সাল, সারা পৃথিবীতেই বিষাদের বছর হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে। এ বছর মহামারি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজনকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। করোনা ছাড়াও অন্যান্য অসুস্থতায় এবছর জাতি হারিয়েছে তার প্রবীণ ও বিদগ্ধ গুণীজনদের। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিকদের পাশাপাশি খ্যাতিমান মানুষদের হারিয়েছে দেশ। চলে গেছেন প্রথিতযশা শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী , সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অভিজ্ঞ পেশাজীবীরা। নিভে গেছে অনেক আইনজীবীর জীবন। করোনায় দেশ যাদের হারিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, চিরবিদায় নিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ, খ্যাতনামা প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দাত হুসাইন, ড. সুফিয়া আহমেদ, অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গির, মূর্তজা বশীর, ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, ড. আলী আসগর, আবুল হাসনাত, শুদ্ধানন্দ মহাথের প্রমুখ।
করোনার বছরে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে রাজনীতিবিদদের। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিম ও সাহারা খাতুন এ বছর মারা গেছেন। করোনায় মারা গেছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম, সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল, ওয়াকার্স পার্টির হায়দার আনোয়ার খান জুনোও করোনায় মারা যান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত) ও আবু ওসমান চৌধুরী, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, জিয় উদ্দিন তারিক আলী, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবদুল হাই করোনাভাইরাসে মারা গেছেন।
চিকিৎসকদের মধ্যে দেশে সর্বপ্রথম করোনায় মারা গেছেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মো. মঈন উদ্দিন। এ ছাড়া আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিফ হেমাটোলজি অধ্যাপক কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান, ইবনে সিনার রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মেজর (অব.) আবুল মোকারিম মো. মহসিন উদ্দিন, করোনায় মারা গেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) হিসাবে একে একে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২২ জন চিকিৎসক।
বর্ষীয়ান আইনজীবী এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং দীর্ঘ ১২ বছর ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল থাকা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং লালমনিরহাটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) ফেরদৌস আহমেদও মারা গেছেন এবছর।
করোনায় মৃত্যুর তালিকায় দেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীও রয়েছেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাসেম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী ও সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল নিলুফার মঞ্জুর, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম ও ব্যবসায়ী এম এ মোমেন।
গণমাধ্যমসহ বেশ কয়েকজন লেখক সাহিত্যিক প্রাণ দিয়েছেন করোনায়। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, রাহাত খান, মুনিরুজ্জামান, বিটিভির সাবেক উপমহাপরিচালক মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকত উল্লা, সাংবাদিক নেতা আবদুস শহিদ, সাংবাদিক হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, দৈনিক সময়েরর আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন ও মাহমুদুল হাকিম অপু, লেখক মকবুলা মঞ্জুর, রশীদ হায়দার ।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য ২০২০ সালটি ছিল শোকে মোড়ানো। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের, সংগীত শিল্পি এন্ড্রু কিশোর, সংগীতঙ্গ আজাদ রহমান, অভিনেতা আব্দুল কাদের, অভিনেতা কে এস ফিরোজ, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী, অভিনেতা সাদেক বাচ্চু, নাট্যকার নির্দেশক মান্নান হীরা, সেলিম আহমেদ, অভিনেত্রী ও নির্দেশক ইশরাত নিশাত, অভিনেত্রী মিনু মমতাজ, নৃত্যশিল্পী হাসান ইমাম, অভিনেতা রানা হামিদ, চলচ্চিত্র প্রযোজক নাসির উদ্দিন দিলু, ক্রীড়াঙ্গনের বাদল রায় প্রমুখ। এছাড়াও বছরের আলোচিত মৃত্যুর মধ্যে আছে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লমা আহমেদ শফী।
তবে, ২০২০ সাল বিপুল প্রাণসংহারের বছর হলেও এর বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা ও গতিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বছর কোভিড- ১৯এর কারণে বিশ্বে যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে, অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে এক বছরে মানুষ এতটা এগোতে পারেনি। সাধারণ সময়ে, একটি টিকা তৈরি করতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এবার এক বছরের কম সময়ে একাধিক করোনার টিকা তৈরি করা হয়ে গেছে এবং অনেক দেশেও প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে।
মানব বিধ্বংসী বছর হিসাবে পরিচিত ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির চমকপ্রদ সাফল্যের পূর্বাভাস পাওয়া গেছে সিইবিআর এর একটি রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দেয়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র ৭ বছর পর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে। অন্যদিকে ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
সিইবিআর তাদের রিপোর্টে বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ভালো। যদিও এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছিল সীমিত, তা সত্ত্বেও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এটি। তবুও এসব পূর্বাভাসে নতুন করে প্রত্যাশাও তৈরী হয়েছে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা