ফজলুল বারী : কারাগারে দুই বছর হলো খালেদা জিয়ার। যিনি থাকতে সেনানিবাসের নয় বিঘা জমির ওপর নির্মিত বিলাসভবনে, সর্বশেষ গুলশানের ফিরোজায়, দুই বছর ধরে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিন জেলে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া যেদিন কারাগারে যান তখন বিএনপির আইনজীবীরা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন আদালতে গেলেই তাঁর জামিন হয়ে যাবে। কাজে তাকে কারাগারে থাকতে হবে সর্বোচ্চ তিন-চার দিন। কিন্তু বিএনপিপন্থী এক সাংবাদিক তখনই আমাকে বলে রেখেছিলেন আদালতে জামিন পাবেননা খালেদা জিয়া। কেনো? এই প্রশ্নের জবাবে তার শান্ত জবাব ছিল খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় মারতে চেয়েছেন অথবা সেই ঘটনার বিচারও করেননি। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে জানে মারবেননা। কিন্তু স্যাতস্যাতে কারাগারে থাকার স্বাদ দেবেন। এতিখানা দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচবছরের কারাদন্ড দেয়। তখন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলছিলেন সাত বছরের কম সাজায় জামিনের নজির আছে। এই কথাটি বন্ধ করতে তাঁর সাজা বাড়িয়ে সাত বছর করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
এরপর থেকে বিএনপি বলতে থাকে এটি সাজানো মিথ্যা মামলা। কিন্তু এটি যে সাজানো মিথ্যা মামলা নয় তা বিএনপির আইনজীবীরা জানতেন। এরজন্যে শুরু থেকে এই মামলার বিচার বিলম্বিত করতে যা যা করা সম্ভব এর সবই তারা করেছেন। এই মামলার তারিখ দেখে বিএনপি নানা সময়ে হরতালও দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আদালত-বিচারকের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে যাওয়া হয়েছে। এভাবে মামলার বিচার চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার জন্যে কুয়েত থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে টাকা এসেছিল। কিন্তু এতিমখানা না করে সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল থেকে সরিয়ে ব্যক্তিগত একাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। সরকারি একাউন্ট থেকে বেসরকারি একাউন্টে টাকা স্থানান্তরের ব্যাংক ডকুমেন্ট এই মামলার মূল প্রমান। মামলার বিচার চলাকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, এতিমখানাটি কোথায়? তারা এর জবাব দিতে পারেননি। কারন খালেদা জিয়া জানতেন তিনি সারাজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই দুর্নীতির খবর পায়নি। মামলা করার নথি ছিল সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। ১/১১’এর সময় তারাই মামলাটি করেছে। এতিমখানা দুর্নীতি মামলা, জিয়া চ্যারিটি দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের সাজা হয়েছে খালেদা জিয়ার।
তবে এটিই প্রথম কারাজীবন নয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের। এরশাদ আমলে তিনি রাজনীতিতে আসেন। তখন এক হরতালের আগে তিনি হোটেল পূর্বানীতে রূম ভাড়া নেন। সেখান থেকে খালেদা জিয়া ও অধ্যাপিকা জাহানারা বেগমকে আটক করা হয়। এরশাদ ভাবী ডাকতেন খালেদা জিয়াকে। জিয়ার মৃত্যুর পর গুলশানে একটি বাড়ি ও নগদ ১০ লাখ টাকা দেন ভাবীকে। একই সঙ্গে সেনা প্রধান হিসাবে সেনানিবাসে জিয়া যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়িও নিজের দখলে রেখে সেখানে বসবাস করে রাজনীতি করতে থাকেন জিয়ার বিধবা পত্মী। হোটলে পূর্বানী থেকে আটকের পর এরশাদ অবশ্য তাঁর ভাবীকে জেলখানায় পাঠাননি। সেনানিবাসের বাড়িতে পৌঁছে দেন।
এরশাদের আমলে একবার খালেদা জিয়া তিন দিনের জন্যে নিখোঁজ ছিলেন। কালিয়াকৈরের জনসভায় থেকে ঢাকায় ফেরার পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। আমি তখন এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছিলাম। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তখন শাহীনা খান নামের বিএনপির এক নেত্রী ছিলেন। সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপের পরামর্শে তখন তিনি নিখোঁজ হন। এই গ্রুপ খালেদা জিয়াকে বলেছে তিনি তিন দিন লুকিয়ে থাকলে তাঁর পক্ষে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান হয়ে যাবে।
আবার একই গ্রুপ এরশাদকে বলেছে খালেদা জিয়া খুব ভাব করেন তিনি সেনাবাহিনীতে খুব জনপ্রিয়। তিনি যে মোটেই জনপ্রিয় নন তা প্রমান করে দেই। ওই অবস্থায় তিনি কালিয়াকৈরের একটি মশার কয়েল ফ্যাক্টরির বাংলোয় আত্মগোপন করে থাকতে শুরু করেন। তখন মোবাইল ফোন থাকায় এমন কেউ নিজে নিজে নিখোঁজ হলে তাকে খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন ছিল। কিন্তু সেই তিন দিন লুকিয়ে থেকেও অভ্যুত্থান হচ্ছেনা দেখে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এসে হাজির হন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন সেনা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তাঁর ঝকঝক শাড়ি, সাজসজ্জায় এর প্রমান ছিলোনা। এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি সেদিন রেগে গিয়েছিলেন।
খালেদা জিয়াকে প্রথমবার অফিসিয়েল গ্রেফতার করা হয় ১/১১ এর সময়। তাও শেখ হাসিনার পরে! অথচ ওই সময়ে খালেদা জিয়া ক্ষমতা থেকে যাবার পথে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানিয়েছিলেন! সেখান থেকে আন্দোলনের মুখে আসে ১/১১ এর সরকার। তখনও খালেদা কারাগার দেখেননি। তাকে রাখা হয় সংসদ ভবনের বিশেষ কারাগারে। পাশাপাশি দুটি ভবনে রাখা হয় শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে। তখন প্রায় শোনা যেত যে কোন সময় খালেদা জিয়া সৌদি আরব চলে যাবেন। রিপোর্টাররা তখন ভিড় করতেন জিয়া বিমান বন্দরে। তখন আমি একটা মজার রিপোর্ট করেছিলাম। খালেদা জিয়া শর্ত দেন সাধারন প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটে তিনি যাবেননা। বিশেষ বিমান চার্টার তথা ভাড়া করতে হবে। তখন শোনা যায় দুবাই থেকে একটি ভাড়া করা বিমান আসবে। সেটিতে করেই তিনি যাবেন। কিন্তু সেই বিমানের ভাড়া দেবেন কে? খালেদা জিয়া না ১/১১’এর সরকার? কেউ তখন বিমান ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিলেননা। এভাবে নয় মন ঘিও জোগাড় হয়নি, রাধাও নাচেনি।
খালেদা জিয়া মাঝে নিজে নিজে তাঁর গুলশানের অফিসে স্বেচ্ছা বন্দী জীবনও কাটিয়েছেন! এর আগে তিনি ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি উপলক্ষে এই স্ববন্দিনী অথবা অবস্থান কর্মসূচিটি করতে চেয়েছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। এরজন্যে তিনি প্রেসক্লাবে তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে অফিস থেকে বেরুতে না দিলে তিনি তাঁর অফিসেই অবস্থান করতে থাকেন। ওই অবস্থায় তাঁর ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যু হয় বিদেশে। কোকোর লাশ তিনি অফিসেই দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে সেই গুলশান অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সে অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এভাবে অফিসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে খালেদা জিয়া এক পর্যায়ে বাসায় ফিরে যান। কিন্তু তার সেই ব্যর্থ অবরোধ কর্মসূচিটি আজ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি।
খালেদা জিয়াকে জেলে নিলে ঢাকায় এবং দেশে লংকাকান্ড হয়ে যাবে এমন একটি ধারনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরেও দেশে সে রকম কোন পরিস্থিতি হয়নি। উল্টো কারাগারে যাবার পর বিএনপি আবেদন করে খালেদা জিয়ার গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকেও তাঁর সঙ্গে বন্দীত্ব দিয়েছে! ফাতেমার হাতে রান্না করা পছন্দের খাবারই তিনি খান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে মজা করে বলেন, খালেদা জিয়া চাইলে তাকে মেকআপম্যানও দেয়া হবে।
খালেদা জিয়া এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের একটি ভিভিআইপি কেবিনে আছেন। কারাগারে যাবার পর তার আর্থাইটিজ ও ডায়াবেটিকসের সমস্যা বেড়েছে। সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্টে খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবার পর তাঁর চিকিৎসা মুক্তির জন্যে বিশেষ আবেদনের কথা ভাবছে পরিবার। মূলত কোকোর স্ত্রী এই প্রস্তাবটি নিয়ে দেশে এসেছেন। বিশেষ আবেদন মানে শর্ত সাপেক্ষ প্যারোলে মুক্তি। কিন্তু তারেক প্যারোলে মুক্তিতে রাজি নন। এ নিয়ে এখন পরিবারটি দ্বিধাবিভক্ত। প্যারোল না জামিন এই বিতর্কে বিএনপি খালেদার মুক্তি নিয়ে যত দেরি করবে তত শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে খালেদার।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা