রহমত রহমান, শেয়ার বিজ নিউজ : দেশে নেই কোনো তামাককর নীতিমালা। ফলে প্রতিবছর কর কাঠামোয় পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া দেশে তামাকের কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল, পুরোনো ও দুর্বল। যাতে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের তামাক অত্যন্ত সস্তা। ফলে কর কাঠামো পরিবর্তন করা হলেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায় না। তবে বর্তমান কর কাঠামো পরিবর্তন করা হলে প্রতিবছর অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় বাড়বে।
কর কাঠামো পরিবর্তনের প্রভাবে সর্বনিম্ন চার হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে তামাকবিরোধী সংগঠন ‘প্রজ্ঞা’র এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুধু অতিরিক্ত রাজস্ব বৃদ্ধি নয়, এতে তামাকের ব্যবহারও কমবে। সেজন্য আগামী বাজেটে তামাকের কর কাঠামো পরিবর্তনের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিগারেটের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে বর্তমানে বহুস্তরবিশিষ্ট অ্যাডভ্যালোরেম (মূল্যের শতকরা হার) প্রথা কার্যকর রয়েছে, যা বিশ্বের মাত্র পাঁচ-ছয়টি দেশে চালু আছে। এছাড়া তামাকপণ্যের ধরন (সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুল), তামাকপণ্যের বৈশিষ্ট্য (ফিল্টার-ননফিল্টার বিড়ি) এবং সিগারেটের ব্র্যান্ডভেদে (চারটি মূল্যস্তর) ভিত্তিমূল্য ও করহারে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। একাধিক মূল্যস্তর ও বিভিন্ন দামে তামাকপণ্য কেনার সুযোগ থাকায় তামাকের ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। কর পদক্ষেপের কারণে একটি মূল্যস্তরে তামাকপণ্যের দাম বাড়লে অথবা ভোক্তার জীবনমানে কোনো পরিবর্তন ঘটলে সে তার পছন্দ বা সুবিধামতো স্তরে স্থানান্তর করতে পারে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে তার রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী অন্য মূল্যস্তরের তামাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
প্রতিবেদনে আগামী বাজেটে সিগারেটের মূল্যস্তর চারটি থেকে কমিয়ে দুটি করার প্রস্তাব করা হয়। যাতে বলা হয়, বর্তমানে সিগারেটে নি¤œ, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়ামÑএ চারটি স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ করারোপের পরও সিগারেটের মূল্য কম হওয়ায় সরকার কাক্সিক্ষত রাজস্ব পাচ্ছে না। বাজেটে করারোপের ক্ষেত্রে নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তর (নিম্নস্তর) এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে আরেকটি মূল্যস্তরে (প্রিমিয়াম স্তর) করার সুপারিশ করা হয়। নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য হবে ন্যূনতম ৬৫ টাকা, সঙ্গে ৫০ শতাংশ হবে সম্পূরক শুল্ক ও সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক ১০ টাকা।
আর প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১২৫ টাকা, সঙ্গে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করা। আর বিড়ির ক্ষেত্রে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ছয় দশমিক ৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করা। এছাড়া ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও পাঁচ দশমিক ৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়।
ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) ক্ষেত্রে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কারোপ করা। প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার ওপর পাঁচ দশমিক ৭১ টাকা ও প্রতি ১০ গ্রাম গুলের ওপর তিন দশমিক ৪৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ আর সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়। তামাকের কর কাঠামোতে যাতে কোম্পানি হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয় এবং বর্তমান ব্যবহারকারীরাও তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। আগামী বাজেটে প্রস্তাবিত তামাককর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সিগারেটের ব্যবহার ১৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে প্রায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ হয়ে যাবে। বিড়ির ব্যবহার পাঁচ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে তিন দশমিক তিন শতাংশ হবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ছয় লাখ বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। অপরদিকে, বর্তমানে তামাক থেকে রাজস্ব আদায় বছরে সর্বনি¤œ চার হাজার ১০০ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে। এ অতিরিক্ত রাজস্ব তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, অকাল মৃত্যু রোধ এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকার ব্যয় করতে পারবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, বাজেটে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি জনগণের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সরকার প্রতিবছর তামাক থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর তামাকজনিত কারণে চিকিৎসা ব্যয় হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কর বাড়িয়ে দাম বাড়ালে রাজস্ব বাড়বে; সঙ্গে চিকিৎসা ব্যয় কমবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেড়েছে ১১ দশমিক ছয় শতাংশ। অথচ সর্বশেষ বাজেটে সিগারেট বাজারের প্রায় ৭২ শতাংশ দখলে থাকা নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে মাত্র পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ। ফলে এ স্তরের সিগারেটের প্রধান ভোক্তা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হবে না এবং একই সঙ্গে ধূমপান শুরু করতে পারে এমন তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজেটে তামাকের কর কাঠামো পরিবর্তন ও দাম বাড়ানো জরুরি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, দেশে সিগারেটের দাম বিশ্বের তুলনায় কম। ফলে রাজস্ব বাড়ানোর সঙ্গে দামও বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কেন তামাককর নীতি হচ্ছে না, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা