ফজলুল বারী : রুবি প্রিন্সেস। এটি একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরীর নাম। কিন্তু এটিকেই এখন করোনা ভাইরাসের রোগী বোঝাই জাহাজ মনে করা হচ্ছে। এমন বেশ কিছু জাহাজ তথা প্রমোদতরী এখন ভাসছে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায়। এগুলোয় এখনও রয়েছেন প্রায় তিন হাজার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক! অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও আছেন। এসব জাহাজের যাত্রীদের সিংহভাগ মূলত পেনশনার বুড়োবুড়ি। এমন জাহাজে করে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াতে তারা পছন্দ করেন। কারন ক্রুজ প্যাকেজের মধ্যে আনলিমিটেড পানাহার সহ বিলাস রাজকীয় জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়।
আমি একবার এমন এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে এমন জাহাজ ভ্রমনের আগ্রহের কারন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমাকে তিনি বলেছিলেন এমন জাহাজে উঠলেই নিজেকে রানী রানী মনে হয়। কোন কাজ করা লাগেনা। যা কিছু চাইতেই বান্দা হাজির। বিছানাও পাল্টে দেয় দিনে কয়েকবার। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে যেহেতু কারোরই কাজের লোক নেই তাই জাহাজ ভ্রমনের আতিথেয়তায় তারা মুগ্ধ হতেই পারেন। এই জাহাজ ভ্রমনের প্যাকেজ যে খুব সস্তা তাও কিন্তু নয়। পাঁচ হাজার ডলার থেকে শুরু করে পনের-কুড়ি হাজার ডলারও পড়ে একেকটি প্যাকেজ ট্যুরের ভ্রমন ব্যয়। অনেকে হয়তো সারাজীবনের সঞ্চয় নিয়ে একবারের জন্যে হলেও এমন একটি জাহাজ ভ্রমনে যেতে চান। কিন্তু এখন যে দুনিয়ার খারাপ সময়। করোনা ভাইরাসের দৃষ্টি পড়েছে এসব জাহাজে। কারন সেখানে যে বয়স্করাই বেশি। যারা এই ভাইরাসের মূল নিশানার নাম।
গত বেশকিছুদিন ধরে এই রুবি প্রিন্সেস অস্ট্রেলিয়ার আলোচিত একটি শিরোনাম। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় যত করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছেন তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রুবি প্রিন্সেস থেকে নামানো যাত্রী। এখন পর্যন্ত তাদের ১১ জনের প্রানহানি হয়েছে। ১৮ তলা জাহাজটিতে আছেন ৫০ টির বেশি দেশের ১০৪০ জন ক্রু। জাহাজটির ক্রু সহ ৬০০ যাত্রীর মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ রয়েছে। ১১ মৃত্যুর পর জাহাজটি নিয়ে ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে সিডনির পুলিশ।
সিডনির লাগোয়া সাগর থেকে সরিয়ে এটিকে ১০০ কিঃমিঃ দক্ষিনের পোর্ট কেম্বলা বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পোর্ট কেম্বলায় যাতে এর যাত্রীদের নামানো না হয় এ নিয়ে একজোট হয়েছে স্থানীয়রা। তাদের মতে এত রোগী রাখার মতো হাসপাতাল তাদের এলাকায় নেই। কিন্তু এখানে রোগাক্রান্ত যাদের অবস্থা জটিল তাদেরতো কোথাও না কোথাও হাসপাতালেতো নিতেই হচ্ছে। এ নিয়ে গোপনীয়তাও অবলম্বন করছে পুলিশ। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের চারপাশে সাগর। চারপাশে এমন ভাসমান ক্রুজ তথা প্রমোদতরীও অনেক। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সাগরে থাকা জার্মান পর্যটক বোঝাই একটি প্রমোদতরী থেকে রোগীদের নামাতে আপত্তি তুলেছিলেন সে রাজ্যের প্রিমিয়ার। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সেখানে হস্তক্ষেপ করে বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায় কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা দেবার নৈতিক দায়দায়িত্ব আমরা এড়াতে পারিনা। অস্ট্রেলিয়ার জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে সেই জাহাজের জার্মান যাত্রীদের বিশেষ বিমানে করে সে দেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার এই করোনা রোগী বোঝাই প্রমোদতরীগুলো দেখি আর বাংলাদেশের অবস্থা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। এমন করোনা রোগীর উৎস বাংলাদেশের নেই। প্রথম কিছু প্রবাসী, এরপর উমরাহ হজের যাত্রী আর আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্য ফেরতদের মাধ্যমে রোগটি বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরপর দিল্লী থেকে সেটি নিয়ে গেছেন তবলিগ জামায়াতের লোকজন। যেখানে মক্কা-মদিনার মসজিদ বন্ধ হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ শুরু থেকে ভয়ে মসজিদ বন্ধ করার কথা বলতে পারেনি! অথচ টোলার বাগের সংক্রমন হয়েছে মসজিদ থেকে। আর বাংলাদেশে একদল ফ্যানাটিক মসজিদে বিলি করা লিফলেটে বলেছে এটি কোন মুসলমানদের রোগ নয়! এটি ইহুদি-নাসারাদের উদ্দেশে আল্লাহর গজব! বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত এ ইস্যুতে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই রোগ প্রতিরোধের বিশ্বব্যাপী মূল দাওয়াই হচ্ছে ঘরে থাকা, জরুরি প্রয়োজনে বেরুলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এরমাধ্যমে এ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ায় এসব আইন অমান্য করলে হাজার ডলার জরিমানা হয়। খালি মাঠে চার পাঁচজনের ক্রিকেট প্র্যাকটিস করা দেখেও পুলিশ সেখানে ছুটে গিয়ে একেকজনকে ১৬৫২ ডলার করে জরিমানা করেছে!
আর সামাজিক দূরত্ব কড়াকড়িভাবে মানার সুফল পেতে শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। সংক্রমনের হার কমে আসছে। আর বাংলাদেশে মানুষকে ঘরে রাখা বিষম দায়! একেকজনের ডাব, পিজা খাইতে মন চায়! তাই বাইরে আসেন! ছুটি ঘোষনার পর মানুষের ভিড় করে বাড়ি যাওয়া, গার্মেন্টস খোলার খবরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভিড় করে ঢাকায় ফেরা এখন আলোচনা-গবেষনার বিষয়। কিন্তু ঢাকার গলির যে চিরায়ত ছবি, বস্তির ঘরে গাদাগাদি করে থাকে পুরো পরিবার! গ্রামের হাটুরেদের অবস্থা, গ্রামের বাজারে মানুষের ভিড় করে চা-সিগারেট খেতে টিভি দেখা, রাজা-উজির মারা! এর কোথাও এই মহামারী নিয়ে ভয় দূরে থাক, এটি মোকাবেলায় মানুষের সিরিয়াসনেসের প্রমান নেই। দেশজুড়ে সবাই একেকজন বিজ্ঞ অজুহাত মাস্টার! এই নাই সেই নাই! সব সরকারের দোষ! কিন্তু রোগটা যে ধরবে তাকে! মরবে সে! এ নিয়ে কারোর কোন বিকারই নেই!
শুরুতে করোনা পরীক্ষার কিটস বাংলাদেশ কেনো, কোন দেশের কাছেই সে রকম ছিলোনা। কারন এই রোগটাইতো এর আগে ছিলোনা কোথাও। মূলত চীন যখন নিজেকে সামলে নিলো তখন চীন থেকেই সবকিছুর সরবরাহ পেতে শুরু করে বিশ্ব। শুধু নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষকে এক হাজার ভেন্টিলেটর উপহার দিয়েছে চীন। আর সারা বিশ্বকে নানা কিছু সরবরাহ করতে করতে চীনের কারখানা শ্রমিকদের এখন ঘুম নেই। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চীনের কাছে করোনা এখন একটি লাভজনক ব্যবসার নাম। কারন বিশ্ব চীন থেকেই সবকিছু কিনছে। জাফর উল্লাহ চৌধুরীদের কিটস ব্যবসা শুরু হতে হতে চীনা কিটসের জিঞ্জিরা সংস্করনও বাজারে চলে আসবে!
আর বাংলাদেশের পন্ডিতরা শুরু থেকে শুধু ট্রল করেই গেছেন! নো টেস্ট নো করোনা ভাইরাস! নিজের দেশের যে টেস্ট কিটসই নেই বা তখন ছিলোনা। নিজের দেশের কতো কিছু নেই বলেইতো এদেশের কোটির বেশি মানুষ বিদেশে থাকেন। এখন যখন কিটসসহ নানা সক্ষমতা বেড়েছে তখন আক্ষেপ কেনো পয়ত্রিশ হাজার রোগী পাওয়া যাচ্ছেনা! এই মহামারী যে ট্রল সামগ্রী নয় বাংলাদেশ! পয়ত্রিশ হাজার রোগী বাংলাদেশে কখনোই হবেনা। কারন বাংলাদেশে রুবি প্রিন্সেসের মতো ক্রুজ নেই, বৃদ্ধানিবাস নেই। আমাদের দাদী-নানীরা পরিবারের অনেকে আদরে নিজস্ব একটি পরিচ্ছন্ন জীবন আছে। মানুষের মাঝে এখনও মমতা আছে।
সবাই নিজে বাঁচুন, ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। ময়লা মাস্ক অবিরাম পরবেননা। সামাজিক দূ্রত্ব যদি মেনে চলা না হয় তাহলে মাস্ক সহ সব সততর্কতাই অর্থহীন। করোনা যুদ্ধে বাংলাদেশে ক্রমশ নতুন নতুন সক্ষমতা অর্জন করছে। এই যুদ্ধ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তোলার অজুহাতবাজরা পেরে উঠছেনা। শুধু মানুষকে নয়, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরকেও খাবার দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের একদল মহামানব! বাংলাদেশে এমন আগে কখনো দেখেছে কি?
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা