ড. ইকবাল হুসাইন : করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট কোভিড-১৯ এ গোটা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। একযোগে গোটা বিশ্বের এরূপ স্থবিরতা নিকট-অতীতে আর দেখা যায়নি। প্লেগ, কলেরা প্রভৃতি মহামারি আকারে আগেও ছড়িয়েছে। কিন্তু তা নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বিশ্বজুড়ে এতটা অচলবস্থা তৈরি হয়নি। কিন্তু করোনা আজ আধুনিক সভ্যতা ও উন্নত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ আজ স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি। অফিস-আদালত, আর্থিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র সর্বত্র সুনসান নীরবতা! বাজার-বিপণিবিতান, রাস্তা-ঘাট, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর সবকিছু ফাঁকা। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমাবেশ নিষিদ্ধ। বিয়ে-শাদি এমনকি আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাতও বন্ধ! বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলায় কেবল সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানবিকতাও অপরিহার্য।
চলতি বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। ফেব্রুয়ারির শুরুতে চীনের বাইরে রোগটির বিস্তার শুরু হয়। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে ১৯০টি দেশ ও অঞ্চলের সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে সাড়ে ছাব্বিশ হাজার। এশিয়ায় চীনের পর সবথেকে বেশি মানুষ মারা গেছে ইরানে। ইটালিতে ২৪ ঘন্টায় করোনা-মৃতের সংখ্যা ৯৬৯ জন। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট মারা গেছে ৯১৩৪ জন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্পেনে একদিনে মারা গেছেন ৭৩৮ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ উন্নত দেশগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং সবাইকে সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) ও বিচ্ছিন্নতাকরণের (আইসোলেশন) মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপরই জোর দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয় ০৮ মার্চ। গত ২০ দিনে দেশে করোনা আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা দু’জন চিকিৎসকসহ মোট ৪৮ জন। এ রোগে এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ০৫ জন এবং ১৫ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। করোনা প্রতিরোধে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগ গহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মূল কর্মসূচি এবং স্বাধীনতা দিবসের গণ-কর্মসূচি বাতিল করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, যেকোনো ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও হাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, গণ-পরিবহণ লকডাউন, অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া এবং সবার বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিতকরণে সশস্ত্রবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করোনা প্রতিরোধে সুফল বয়ে আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে কোভিড-১৯ রোগী সনাক্তকরণের কিট বা রিএজেন্ট এবং চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণের (পিপিই) স্বল্পতা সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি হিসেবেই বিবেচিত। এছাড়া কোভিড-১৯ রোগীর জন্য হাসপাতালের শয্যা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং চিকিৎসাকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
চীনের প্রায় আড়াই মাস পর বাংলাদেশে করোনা-রোগী সনাক্ত হলো। ইতোমধ্যে এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব গোটা বিশ্বকে শঙ্কিত করে তুলেছে। অধিকাংশ দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নানা প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে কোভিড-১৯ টেস্টের কিট/রিএজেন্ট এবং পিপিই আগাম আমদানি করা হলে বর্তমান সঙ্কট তৈরি হতো না। আমরা যতই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি না কেন, রোগ সনাক্তকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা ব্যতীত করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা অলীক ভাবনা। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দু’টি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। সন্দেহভাজন রোগীর করোনাভাইরাস পরীক্ষা সহজলভ্য করা জরুরি। প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং মেডিক্যাল কলেজে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। দক্ষিণ কোরিয়াসহ যেসব দেশ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে তারা খুব দ্রুত আগ্রহী এবং সন্দেহভাজন সব রোগীর পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে এ সময় সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর-গলাব্যথার প্রকোপ দেখা দেয়। এ কারণেও সন্দেহভাজন যেকোনো রোগীর দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া জরুরি যে তার মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আছে কিনা। তাছাড়া চীনসহ বিভিন্ন দেশে অনেকের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও কোনো উপসর্গ দৃশ্যমান হয়নি। সুতরাং লক্ষণ বা উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে করোনা-পজিটিভদেরকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কেবল বিদেশ ফেরৎ বা তাদের সংস্পর্শে আশা ব্যক্তিবর্গ নয়, সন্দেহভাজন যেকোনো মানুষের সহজে এবং স্বল্পমূল্যে এ পরীক্ষা করা হলে সামান্য লক্ষণ দেখা দিলেও মানুষ পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হবে।
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক দুর্যোগ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও এ দুর্যোগ মোকাবিলায় রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দেশে সরকারের একার পক্ষে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেক বেশি কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের সচেতনতা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগতিা অপরিহার্য। যেমন পিপিই প্রস্তুত ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিজিএমইএ নেতৃত্বে বড় বড় পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। টেস্ট-কিট বা রিএজেন্টসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন। পরীক্ষার জন্য ল্যাব স্থাপন, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানী এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি যেকোনো পর্যায় থেকেই হতে পারে। ইটালিসহ বিদেশ ফেরৎ নাগরিকদের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, ভুয়া ঠিকানা দিয়ে নিরুদ্দেশ থাকা, হোম কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনে অনীহা ও অসহযোগিতা, হাসপাতাল থেকে সন্দেহভাজন রোগীর পালিয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন ঘোষিত ভবন দেখার জন্য উৎসুক মানুষের ভীড় ইত্যাদি কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতা এবং গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণায় গত কয়েকদিনে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর অপ্রয়োজনে কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। বলা যেতে পারে, ঢাকাসহ সারা দেশে লকডাউন অবস্থা!
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’র সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। ‘কুইনিন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে?’ লকডাউন হয়ত করোনা প্রতিরোধ করবে, কিন্তু দরিদ্র, শ্রমজীবী, রিকশাচালক ও দিনমজুর মানুষের আহার জুটবে কীভাবে? একদিন কাজ না করলে এদের অনেকের ঘরে চুলা জ্বলে না। কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোর সরকার তাদের নাগরিকদের খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকারের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। পাশাপাশি সরকারি কোনো সহযোগিতা জনগণের কাছে পৌঁছাতে দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতা সর্বজনবিদিত। তাই কেবল সরকারি সহযোগিতার উপর নির্ভর না করে সামর্থ্য অনুযায়ী সবাইকেই এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই নিজ নিজ উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের আরো অনেক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। লকডাউন অবস্থা যদি একমাস কিংবা আরো বেশি সময় অব্যাহত থাকে তবে করোনা থেকে বাঁচলেও অনেকে অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত, করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি একজন মানুষকেও আমরা অনাহারে থাকতে দিব না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধিগণ নিজ নিজ এলাকার রিকশাচালক, দিনমজুর, দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। যারা বিত্তবান তারা তাদের পরিচিত, প্রতিবেশী এবং দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনকে সহযোগিতা করতে পারেন। অনেক শ্রমজীবী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত ছিলেন। প্রকল্প-কর্তারা এদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে পারেন। সরকারি নির্দেশনায় শিল্প-কারখানা যতদিনই বন্ধ থাকুক সব শ্রমিকের পূর্ণ বেতন নিশ্চিত করতে হবে। করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে সরকার পোশাক শ্রমিকদের কল্যাণে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। দেশের অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকরাও যাতে এ সময় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হন তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশের সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ‘মাস্টারোল’ বা দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কর্মচারী আছেন। ‘করোনা-ছুটি’তে তাদের দৈনিক হাজিরা কর্তন না করে বিশেষ বিবেচনায় সারা মাসের মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। করোনার এই ক্রান্তিকালে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগতভাবে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন তার সুফল যেন তাদের হাতে সঠিক সময়ে পৌঁছায়। দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ পার হওয়ার পরে সহায়তা পাওয়া অনেকের কাছেই অর্থহীন বিবেচিত হতে পারে।
# ড. ইকবাল হুসাইন, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ihusain1979@gmail.com