ফজলুল বারী : আজ একটা ছেলে দেখা করতে এসেছিল। মনে করেছিলাম নতুন ছেলে। সিডনিতে আসা নতুন বাংলাদেশি ছাত্ররাই মূলত একটা চাকরি বা কোন সহযোগিতার জন্যে দেখা করতে আসেন। কিন্তু এই ছেলেটি আসার পর কয়েক কথায় বুঝতে পারি ছেলেটি এদেশে নতুন নয়। এই সিডনিতে তাঁর বয়স প্রায় সাড়ে তিন বছর। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা অথবা ভালো অভিভাবকত্বের অভাবে পড়াশুনা বা চাকরি কোন কিছুতেই থিতু হতে পারেনি ছেলেটি। এর অন্যতম একটি রোগ ছিল দেশের মানুষ বাংলাদেশিদের তার ভালো লাগেনা! এরজন্যও সাড়ে তিন বছর পরেও এখানে তার না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা। অথচ এই সময়ে ভালো পড়াশুনা শেষে ভালো চাকরি, এমনকি অভিবাসন হয়ে যাবারও উদাহরন কম নয়।
এই ছেলেটার রোগটা ধরার পর বললাম ভাইরে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় দু’শ দেশের মানুষের বসবাস। সবাই এখানে এই বহুজাতিক সমাজে যার যার কমিউনিটিকে নিয়েই প্রতিষ্ঠিত। এই ছেলেটি যে রেষ্টুরেন্টে কাজ করতো করোনা পরিস্থিতির কারনে সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে কাজ হারিয়েছে। উবার ইটস তথা ফুড ডেলিভারির চাকরিতেও মন্দা চলছে চলতি পরিস্থিতিতে। একটা চাকরির আশায় নিরুপায় অবস্থায় ছেলেটি সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বললো, বাড়ি থেকে টাকা আনার অবস্থা আর নেই। আমার সামনে সে আমার বাংলাদেশ। বললাম নতমাথা হওয়া চলবেনা। একটা ব্যবস্থার আশ্বাস নিয়ে ফিরে যায় ছেলেটি।
করোনা ভাইরাসকে নিয়ে সারা বিশ্বের মতো অস্ট্রেলিয়ার নানাকিছুতেও এখন নাজুক অবস্থা। বুধবার পর্যন্ত এখানে এ রোগে ৬ষ্ঠ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫৪ জন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়া নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করেছে এ দেশের জাতীয় এয়ারলাইন্স কোয়ানটাস। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের আগামী ছয় মাস বিদেশ যেতে নিষেধ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। তবে স্কুল, শপিংমল, যানবাহন এখনও চালু আছে।
স্কুল বন্ধ করার সমস্যা এদেশের বেশিরভাগ বাবা-মা কাজ কাজ করেন। স্কুল বন্ধ করলে তাদের কাজ করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। শপিংমল চালু থাকলেও প্যানিক বায়িং’এর কারনে এগুলোর টয়লেট টিস্যু সহ নানান খাবারের সেলফগুলো প্রায় খালি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এসব খাবার সহ ভোগ্যপন্যের কোন ঘাটতি নেই। শপিংমলের গ্রাহক চাপের কারনে এগুলোর ছাত্র কর্মীদের কাজের সীমাবদ্ধতা শিথিল করা হয়েছে। আগে একজন ছাত্র সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারতেন। সেই ছাত্র এখন কাজ করতে পারবেন আনলিমিটেড সময়। বুধবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিশন ২০ হাজার নার্সিং স্টুডেন্টদেরও কাজ করার লিমিটেশন প্রত্যাহার করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় ইনডোরে ১০০, আউটডোরে ৫০০’র বেশি জনসমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
সংকট মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষনা করা হয়েছে নানান স্টিমুলেজ প্যাকেজ। পেনশনার, বেকার ও নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে এককালীন আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া ছোট ব্যবসা ও কর্মচারীদের বেতন চালু রাখতে দেয়া হচ্ছে এককালীন আর্থিক প্রনোদনা। আগামীতে আরো প্রনোদনা ঘোষনার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সরকার। বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলোও পৃথক প্রনোদনার ঘোষনা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এর সবকিছুই ভোগ করবেন এদেশের নাগরিকরা। বিদেশি ছাত্ররা এসব প্রনোদনার আওতায় আসবেননা। কোন বিদেশি ছাত্র, কোন বাংলাদেশি এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। কিন্তু ইতালির মত লকডাউনের ঘটনা ঘটলে সবাই এর ভুক্তভোগী হবেন।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তির বুধবার মৃত্যুসংবাদ দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরনকারী বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তিটির বয়স ৭০ বছর। বিদেশ থেকে আসা ও সংক্রমিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হতভাগ্য ওই ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর হার্টে স্টেন্ট পরানো ছিল। বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ জন।
নতুন আক্রান্ত ৪ জনের একজন নারী ও তিনজন পুরুষ। একজন পূর্বে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন। বাকি তিনজনের দুজন ইতালি এবং একজন কুয়েত থেকে এসেছেন। আমরা আগেই লিখেছি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনার ব্রিফিংটি খুব চমৎকার হয়। মোটামুটি সব তথ্যই থাকে ব্রিফিং’এ। কিন্তু বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির আর কোন কিছুই এই ব্রিফিং’এর মতো চমৎকার নয়। করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীর প্রধান কর্মসূচি বাতিল করা হলেও বাংলাদেশের কোথাও সতর্কতার প্রমান নেই। বিমান বন্দর দিয়ে ঢুকে পড়াদের যথাযথ পরীক্ষা হয়নি। বিদেশ ফেরত, বিশেষ করে ইতালি ফেরতদের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বেশি সংক্রমনের ঘটনা ঘটছে! এরমানে হোম কোয়ারিন্টাইন ঠিকমতো হচ্ছেনা।
বিমান বন্দরে যারা পরীক্ষার দায়িত্ব ছিল তাদের ব্যক্তি নিরাপত্তার যথাযথ প্রশিক্ষন-সতর্কতা ছিলোনা। যেখানে আক্রান্তদের চিকিৎসা হবে-হচ্ছে সেগুলো এখনও নোংরা ও জীবানুযুক্ত। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন, রাজনৈতিক কর্মসূচি-বক্তৃতাবাজি হচ্ছে! স্কুল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছিল। কথা ছিল স্কুল বন্ধের পর ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে থাকবেন। কেউ কথা শুনছেননা। সবাই ছুটছেন সমুদ্র সৈকত সহ নানান পর্যটন স্পটে। ঈদের ছুটির মতো আনন্দে সবাই যানবাহন ভর্তি করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন! গ্রামের বাড়ি যাবার পথ গাড়িতে, গ্রামের বাড়ি গিয়ে তারা বিদেশ ফেরত জীবানুবাহকদের সংস্পর্শে আসতে পারেন। একসঙ্গে অনেকজন মিলে সংক্রামিত হতে পারেন গ্রামজুড়ে! এক সময় বাংলাদেশে কলেরা গ্রামের আতঙ্ক ছিলো। এখন যাতে করোনার গ্রাম না হয় সে প্রার্থনা সবাই করুন।
বাংলাদেশের শাসকদলের মুখপাত্র ওবায়দুল কাদের বুধবার বলেছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশেও লকডাউন করা হবে। যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু এসবের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের কোথায় কিভাবে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হবে এ নিয়ে কোন কর্মপন্থা ঠিক করেছে কী সরকার? লকডাউন হলে মানুষ কাজ হারাবে। খাদ্য-ভোগ্যপন্যের সরবরাহ ঠিক না থাকলে দাম বাড়বে। সক্রিয় হবে মুনাফাখোরের পাল! বাংলাদেশ আসলে এমন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতোটা প্রস্তুত? বিদেশে বসে শুধু আমরা প্রানভরে প্রার্থনা করতে পারিঃ নিরাপদ থাকুক আমাদের জন্মভূমি।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা