ড. শেখ বাতেন : পৃথিবীব্যাপী করোনা ভাইরাসের এই বিস্তারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বিপদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে কোনো কিছুর বিস্তারই কিন্তু আগের মতো নয়।
এটা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রযুক্তির কারণে। প্রযুক্তি যে শুধু মানুষের মানুষের প্রাপ্তির বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে তা নায়, এটা বিপদেরও বিশ্বায়ন সৃষ্টি ক্ষমতা রাখে। এটা অধিকার, আন্দোলন, সুবিধার বিস্তার ঘটাতে পারে পাশাপাশি বিপদের বিস্তার ঘটাতে পারে। এটা চিন থেকে পাশ্চেতের অগ্রসর দেশগুলোতে, তারপর দ্রুত বাংলাদেশের ঢাকা, চিটাগ্রাম কিংবা কুমিল্লায় চলে আসছে। মহামারী আগেও ছিল, কিন্তু এই গতি এর আগের মহামারির বেলায় ছিল না। এটা যে ঠিক কতদূর যাবে আমরা আন্দাজ করতে পারছিনা। সমাজবিজ্ঞানীরা এখন এটার সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট নিয়ে ভাবছেন।
তারা মনে করছেন, পৃথিবীর অনেক কিছুই এলোমেলা করে দিয়ে যাবে, বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদী সিস্টেমগুলো পরিবর্তন ঘটাবে। পুঁজিবাদের একটা বড় বৈশিষ্ট হলো, এটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যে, প্রতিযোগিতায় যে বাঁচবে সিস্টেম তার জন্য কাজ করবে। নিওলিবারেলিজমের মূল কথা হল, এখানে চিকিৎসা সেবাকে কখনই ব্যক্তির অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়না, এটা বাজারের ব্যপার। ব্যক্তি সিস্টেম থেকে যদি সেই সুবিধা নেয়ার যোগ্যতা রাখে, যদি পারচেজ করতে পারে তাহলে ব্যক্তি এটা পাবে। আর না পারলে তার প্রতিযোগিতার জগতে সে টিকবে না।
এই যে ধারণাগুলো বিভিন্ন সময়ে যে তৈরি হয়েছে, এগুলো মানুষের বাঁচার বেসিক সিস্টেমকে আজ লজ্জা দিচ্ছে। । করোনা ভাইরাসের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের একজন গবেষক বলেছিলেন, তোমরা ফিল্মস্টারকে কোটি কোটি টাকা দিতে পার, স্টেডিয়াম তৈরি করতে পার, স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্ধের দিকে তোমাদের কোন দৃষ্টি ছিল না; তোমাদের বাচার অধিকার নেই। অনেক কিছুই তোমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা হঠাৎ করে হয়েছে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। দীর্ঘসময় মানুষের বেসিক জিনিসকে অগ্রাহ্য করার জন্য এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের বড় নেতারা তাদের দেশের জনগণকে রক্ষা করতে পারছে না মৃত্যুর পরিসংখ্যান এটা আমাদেরকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
অনেক আগেই মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী সি রাইট মিলস বলেছিলেন: জগতে যে বেদনা আছে মানুষের, পন্ডিতেরও মানব জীবন যাপন করতে গিয়ে পন্তিত মানুষ যা অনুধাবন করে, যে পার্সোনাল ট্রাবল আছে, তার উপরে ভিত্তি করে যদি গবেষনার এজেন্ডা ঠিক না করা হয়, তাহলে গবেষনা পৃথিবীর কাজে লাগবে না। পৃথিবীর অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটবে কিন্তু মানুষের ক্রাইসিসকে ঠিকমতো এড্রেস করা যাবে না। এটা করা না যাওয়ার ফলে বিপজ্জনক পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যে তৈরি হতে পারে এটা গত ২০/২৫ বছর ধরে বিশ্বের শ্রেষ্ট সমাজতাত্তিকেরা তার তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এই বক্তব্য যিনি উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন, তিনি জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ওল্ডরিচ বেক। তার বিখ্যাত তত্ত্ব হচ্ছে – “ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ” বা ”রিস্ক সোসাইটি” । তিনি বলছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে টেকনোলজি এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তবতা এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে মানুষ আন্দাজ করতে পারছে না তার চারপাশের অনেক বিপদকে। আন্দাজ করার দায়িত্ব তাকে দেয়া হচ্ছে না। বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত টেকনোলজির শক্তিগুলো এত বেশি মানুষের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে যে মানুষ এটার ক্রীড়নক হয়ে পড়েছে। । নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে দেশে দেশে, যেটাকে গণতন্ত্র বলা হয় তা মোটামুটি ব্যথ হয়েছে। এই গণতন্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যে ধরণের ব্যাখ্যা দেয়, স মাজবিজ্ঞানিরা দ্বিমত করেন, পার্লামেন্ট- এখন আর গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত না। গণতন্ত্রে বেনিফিক পাচ্ছে উপরের দিকে কিছু সংখ্যক লোক।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক নেই। জামান সমাজবিজ্ঞনী, শিকাগো স্কুলের সাম্প্রতিক সময়ের সদস্য ইউজেন হেবারমাস বলেছেন, আমাদের জগৎ এবং সংসদ, গণত্ন্র, ভোট একেবারে আলাদা। এই জগতগুলো আমাদের দু:খ-কষ্টের সঙ্গে সম্পর্কিত না। আমাদের বিপদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় । বিপদের সময়ে আমাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে এটাও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। এই টেকনোলজি এবং তার বিকাশ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদেরকে কলোনাইজ করে ফেলেছে। আমরা উপনিবেশিক হয়ে গেছি আমাদের সিস্টেমের কাছে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তথ্য সম্পর্কে মানুষ যত কম জানবে তত বেশি মানুষের বিপদজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
আমরা দেখেছি বাংলাদেশে সেই প্রশ্ন কিছুটা উঠেছে। সুতরাং মোর ডেমোক্রেসি, কারণ মানুষ জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে তাদের হাতে হেলথ-সিস্টেম নেই। তাদের হাতে তথ্য নেই। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থে গবেষণা পরিচালিত হয় না। এমনকি ইনটেলেকচুয়ালরাও স্টাবলিশমেন্টের কেনা গোলামে পরিণত হয়ে গেছে। গবেষণার এজেন্ডা তৈরি করে বিশ্বব্যাংক, ফান্ড করে তারা। তারা কখনোই হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়নি। এ সিস্টেম আমাদের ও আমাদের সন্তানদের বেঁচে থাকার জন্য, মানুষের মহামারিকে মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট নয়।
এই বক্তব্য আগামী পৃথিবীতে দ্রুত চলে আসবে। বিদ্যমান কারোনা বিপর্যয়ে এই দাবিগুলো সভ্যতার কেন্ত্র ও প্রান্তে, দেশে দেশে মনোযোগের কেন্ত্রিয় এলাকায় চলে আসবে। অচিরেই দীঘমেয়াদে সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, বিশেষ করে ক্ষমতার কাঠামোতে, শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন তৈরি করবে, প্রেডিকশন করা যায়।
# ড. শেখ বাতেন, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ।
অনুলিখন, তাসকিনা ইয়াসমিন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লালসবুজের কথা ডটকম।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা