মোহাম্মদ সোহেল রানা : শীতকালকে বলা হয় ওয়াজের মৌসুম । শীতের আগে এবং পরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে, গ্রামে-গঞ্জে পাড়া-মহল্লায় সারারাত ধরে ওয়াজ চলে । ওয়াজ মাহফিলগুলো বিকেল থেকে আরম্ভ হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে । ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো সওয়াবের আশায় ওয়াজ শুনতে যায় । সাম্প্রতিক কালে দেখা যায় ওয়াজ মাহফিলগুলো বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে । ওয়াজ মাহফিল করার জন্য ওয়াজকারীদের ভাড়া করে আনতে হয় । চুক্তি করে এসে ওয়াজকারীরা ওয়াজ করে ।
কেউ বিশ হাজার, কেউ পঞ্চাশ হাজার বা এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে এসে ওয়াজ করে । কোনো কোনো ওয়াজকারী আবার হেলিকপ্টারে করে এসে ওয়াজ করে । সারারাত ওয়াজ করে পরের দিন সকালে বান্ডেলে বান্ডেলে টাকা নিয়ে চলে যায় । এমনকি আজ বিভিন্ন স্থানে যারা ওয়াজ করে ওয়াজকারীরা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে থাকেন, একজন আরেকজনকে কাফের মুরতাদ বলে ফতোয়া দেন । সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে । বর্তমান সময়ে ওয়াজের নামে একদিকে চলছে বাণিজ্য ঠিক তেমনি আবার চলে জাতিবিনাশী কর্মকান্ড ।
আমাদের সমাজে ধর্মকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কথিত আলেমরা ইসলামের অবমাননা করে যাচ্ছেন । আজ এক ওয়াজিয়ান আরেক ওয়াজিয়ানের বিরুদ্ধে কাল আরেক ওয়াজিয়ান অন্য ওয়াজিয়ানের বিরুদ্ধে ওয়াজ করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে উস্কে দেন । কোনো কোনো ওয়াজিয়ানরা ওয়াজ মাহফিলকে হাসির পাত্রে আবার কেউ কেউ রণহুঙ্কার দেন; এমনকি নারীদের প্রতিও বিদ্বেষ ছড়ান ।
এভাবে একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা আজ নারীদেরকে বাক্সবন্দী করেছেন । সম্প্রতি শীতের মৌসুমে ওয়াজ মাহফিলের নামে ভয়াবহ নারী বিদ্বেষ উস্কে দিচ্ছে ধর্মান্ধ উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী । তারা ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বলেন, নারীরা হচ্ছে সমাজের বোঝা । তারা ঘরের ভিতরে বাক্সবন্দী থাকবে। নারীদের ওপর শয়তান ভর করে ইত্যাদি । কেউ যদি ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে নাস্তিক, মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উস্কে দেয় ।
আজ যেভাবে মুসলিম নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছেন , সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ীদের বিমান হামলায় সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান ধ্বংস হয়ে গেল, যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিমান হামলায় কিছুদিন আগে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান সোলেমানীকে হত্যা করা হলো তাদের ওয়াজে এতটুকু কোনো ফল হয়নি । তারা জাতিকে, মাটিকে রক্ষা করার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন না । একটি নারীর ইজ্জত তারা রক্ষা করতে পারেননা ।
ওয়াজ মাহফিলের নামে টাকা নেয়া বা ওয়াজ মাহফিলকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা এক ধরণের ধর্মব্যবসা । কারণ আমরা জানি, ইসলামের কাজ তথা ধর্মের কাজ করতে হয় নি:স্বার্থভাবে । ধর্মের কাজ করে বিনিময় নেয়া বা ধর্মকে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা হারাম । আল্লাহ এই কাজকে শুধু হারামই করেননি একে আগুন খাওয়ার সমতূল্য বলেছেন । আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন তা যারা গোপন করে এবং তার বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না ।
আল্লাহ তাদের সাথে কোনো কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না । তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব । তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ও হেদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী ক্রয় করেছে । সেই আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্য্যশীল । ( সুরা বাকারা: ১৭৪-১৭৫) আল্লাহ আরো বলেছেন, তোমরা তাদেরকে অনুসরণ করো যারা কোনো বিনিময় নেয় না আর যারা সঠিকপথে আছে । ( সুরা ইয়াসিন:২১) আল্লাহ যেখানে বলেছেন ধর্মের কাজ বা ধর্মপ্রচার নি:স্বার্থভাবে করতে সেখানে আল্লাহর হুকুমকে অমান্য করে ধর্মব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।
আমাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ী একটি শ্রেণি নামাজ পড়িয়ে, মিলাদ পড়িয়ে, জুম্মা পড়িয়ে, জানাজা পড়িয়ে, বিয়ে পড়িয়ে, মূর্দা দাফন করে, কোরআন খতম দিয়ে, ওয়াজ করে , মসজিদ, মাদ্রাসার নামে চাঁদা তুলে অর্থ রোজগার করছে আবার কেউ অপরাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে । ওমুক ওমুক মার্কায় ভোট দিলে জান্নাতে যাওয়া যাবে এই কথা বলে ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানি চেতনাকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিল করে চলছে ধর্মব্যবসায়ী অপরাজনীতিকারীরা ।
আজ ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ওয়াজিয়ানরা যেভাবে পাগলামি করেন, রণহুঙ্কার দেন, মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ান তা জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত । বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম তার “ধর্মব্যবসা ফাঁদে” নামক বইতে ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকান্ডে কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে তা তুলে ধরেছেন । আজ ওয়াজ মাহফিলের নামে চলা জাতিবিনাশী কর্মকান্ড বন্ধ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা