সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার : ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা বলেছেন, এখানে আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আশ্বস্ত করেছেন যে, এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের উপর এর কোন প্রভাব থাকবে না। আমরা এই ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি।
তিনি বলেন, নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে এবং অনেকগুলো অভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা থাকায় এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের দুই দেশেরই কিছু ঘটনা কারণে বা অকারণে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আসামে নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদকরণ, যে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে ।
সোমবার (২ মার্চ) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এসময় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আমাদের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রয়াত শ্রীমতী সুষমা স্বরাজ দুই বছর আগে ঢাকায় বলেছিলেন যে, আমাদের জন্য “প্রতিবেশী প্রথমে” এই নীতির বাস্তবায়নে “বাংলাদেশই প্রথমে”। আমরা যতটা জল, স্থল আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সংযুক্ত ততটাই সংযুক্ত আমাদের অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে। বাংলার মাটি এবং বাংলার জল আমাদের দুই দেশকে সমৃদ্ধ এবং লালনপালন করে; আমাদের সমাজ ও আত্মাকে টিকিয়ে রাখে। এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গভীরতম সাদৃশ্যের ভিত্তিতে যাকে অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব।
দুই দেশের মধ্যে ৭৫টি আলোচনার বিষয় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের স্থায়ী অংশীদারিত্বের একটি শক্তিশালী কাঠামো গঠনের জন্য আমাদের জনগণ ও সরকারকে যুক্ত করেছে। মানুষে মানুষে বন্ধনের এই পর্যায়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বেশি ভিসা কার্যক্রম এবং ভারতে বিদেশী ভ্রমণকারীদের সবথেকে বড় সংখ্যক হচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুগণ। সরকার, ব্যবসায়, নাগরিক সমাজ এবং জনগণের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম সহযোগিতামূলক সম্পর্কে একটা প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয় যেখানে পারস্পরিক স্বার্থ থাকে। অন্যকথায়, একটা সত্যিকারের বিকশিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হচ্ছে যেখানে একপক্ষের স্বার্থ সংরক্ষিত না হলে অন্যপক্ষের স্বার্থ নষ্ট হবে। সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে আমাদের একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, আজকে আমরা একটা মধুর সমস্যার সম্মুখীন: যে গতিতে আমাদের সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে তা আমাদের আশা এবং আমাদের সরকারের সক্ষমতা দুটোই ছাপিয়ে গেছে।
ভারতে ভ্রমণ সহজ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত ভ্রমণের জন্য যেখানে অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো ভিসার জন্য সেখানে আজকে আমরা এমন পর্যায়ে রয়েছি যেখানে অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকেই ভারতে বেশি পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া, ১৯৬৫ সালের আগেকার ৬টি রেল সংযোগ ২০২১ সালনাগাদ আবারো চালু হবে, যার ফলে স্থলপথে যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবেই উন্নত হবে।
৫৪ নদীর পানিবন্টন ইস্যু প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা। আমি জানি, আমাদের মত ঘনবসতির ও জীবিকার জন্য নদীর উপর নির্ভরশীল দেশে এই বিষয়টা কতটা নাজুক। এটা প্রমাণিত যে, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং ন্যায্য বণ্টন করার মধ্যেই আমাদের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ নিহিত। আমি বলতে পেরে খুশি হচ্ছি যে, আমাদের দুই পক্ষই স্বীকার করে যে, অভিন্ন নদী বিষয়ে আমাদের আরও উন্নতির সুযোগ আছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগস্ট ২০১৯ থেকেই দু’পক্ষের মধ্যে সংলাপ শুরু হয়েছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানিসংকটের সর্বোত্তম সমাধান খুঁজতে এবং আমাদের পানি ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন করতে আমরা বদ্ধপরিকর, যেন এসব নদীগুলো আগামী প্রজন্মেও জীবিকার উৎস হয়ে থাকতে পারে।
তিনি বলেন, এই একই প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশের কোন ব্যয় ছাড়াই সমান লাভজনক সমাধান সম্ভব হয়েছে যেখানে লাভজনক ব্যবসা সৃষ্টি করা যাবে। যেমন: বিদেশ থেকে আসা এলপিজি চট্টগ্রাম থেকে কিনে বাংলাদেশী বিশেষ ট্রাকে করে ত্রিপুরায় সরবরাহ করা। এর মাধ্যমে ভারতের শুধু সাশ্রয়ই হবে না, এর ফলে এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ভারতের মধ্য দিয়ে দীর্ঘসড়ক পথে পণ্য পরিবহণের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ কমাবে। একইভাবে, সড়ক, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বন্দরের মত আন্ত:সীমান্ত যোগাযোগ উন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোও এই বিশ্বাসেই করা হচ্ছে যে, এগুলোর মাধ্যমে উভয় দেশ সত্যিকারভাবে উপকৃত হবে। এমন অংশীদারিত্ব একমুখী নির্ভরশীলতার পরিবর্তে দ্বিমুখী আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ যদি ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে তাতে আপনাদের বাজারের উপর আমাদেরও নির্ভরশীলতা বাড়বে। একইভাবে, আপনারা যদি দ্বিপাক্ষিক এবং আন্ত:সীমান্ত যোগাযোগ সুবিধা প্রদান করেন তাহলে শুধু বাংলাদেশে কর্মসংস্থানেরই সৃষ্টি হবে না, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর ভারতের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক সংকট এবং বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব বিষয়ে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অনেকের আগ্রহ এবং ভিত্তিহীন ধারণাও আছে। আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, ভারত বাংলাদেশের মানবিক বোধের গভীর প্রশংসা করে, যার কারণে তারা প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আপনারা যে বোঝা বহন করছেন আমরা তা স্বীকার করি ও সমবেদনা জানাই। আমরাই বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়েরই একমাত্র সত্যিকার বন্ধু দেশ। যেখানে অন্যদেশগুলো চায় আপনারা এই সমস্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়ে চলুন, সেখানে আমরা পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে একটা সমাধান চাই এবং এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর রাখাইনে দ্রুততম প্রত্যাবাসন ও সম্মানজনক জীবন ফিরে পেতে সহায়তা করতে আমরা অঙ্গিকারবদ্ধ। এই প্রত্যাবাসন হতে হবে নিরাপদ ও টেকসই।
অন্যদিকে, আমরা মিয়ানমার সরকারের সাথে সব পর্যায়ে ধারাবাহিক আলোচনা চালাচ্ছি যেখানে আইডিপি ক্যাম্প বন্ধ করা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করা এবং বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে যাবার জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করায় গুরুত্ব দিয়েছি। অন্যকথায়, এই বিশাল মানবিক সংকট মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই বিষয়ে আমাদের পরামর্শ হলো, আমরা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করব বাগাড়ম্বর না করে যেন এই সমস্যার একটি মানবিক ও বাস্তবসম্মত সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা