ফজলুল বারী : ক্যাপ্টেন মাশরাফি চলেই যাচ্ছেন। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ক্যাপ্টেন মাশরাফির প্রস্থানের মঞ্চ হিসাবে স্মরনীয় হয়ে থাকলো। অথবা তাঁকে এখন এভাবে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। টেস্ট, টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব আগেই তাঁর হাত থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। বাকি ছিল ওয়ানডে অধিনায়কত্ব। সিলেটে বৃহস্পতিবার মাশরাফি যে ঘোষনাটি দিয়েছেন তা কোন বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়। এমনটাই চাইছিলেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন। এই কিছুদিন আগেও তিনি তার প্রত্যাশা জানিয়েছেন। ক্যাসিনো কান্ডের জন্য আলোচিত-বিতর্কিত বিসিবি বস সর্বশেষ মাশরাফিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন গ্রেটরা জানে কোথায় কিভাবে থামতে হয়। বিসিবি বসের তীর্যক কটাক্ষটি ছিল মাশরাফি এটি জানেননা! আগামী বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে অধিনায়কত্ব ছাড়তে মাশরাফির প্রতি এক রকম চাপও ছিল বিসিবি বসের। মোটামুটি আভাস ছিল এভাবে অধিনায়কত্ব বা দল না ছাড়লে তাঁকে বাদই দেয়া হবে। কাজেই মাশরাফির ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়ার সংবাদ সম্মেলনটি লাইভ দেখার সময় মন ফুঁড়ে যে প্রতিক্রিয়া বেরোয় তাহলো, তোমাকে দ্রুত দলও ছাড়তে হবে কৌশিক। এখন বিরূপ সময়। অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষনা দিলেও ওয়ানডে দলে থেকে যাবার আকুতি ছিল কৌশিকের। কিন্তু এখন ফিটনেস নিয়ে কথা হবে। যদিও এখন পর্যন্ত প্রতিটি ফিটনেস টেস্টে ১১ তে ১১ পেয়েই কৌশিক তাঁর অবস্থান ধরে রেখে আসছেন। উল্লেখ্য কৌশিক মাশরাফির ডাক নাম। নড়াইলে ফোন করে কথা বললাম মাশরাফির বাবা গোলাম মোর্তজার সঙ্গে। গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের সময় থেকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটি ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের। আমরা তখন একসঙ্গে অনেক চমৎকার সম্পর্ক কাটিয়েছি। ছেলের ক্রিকেট কাপ্তানি ছাড়ার ঘোষনার পর খুব স্বাভাবিক তাঁর মন খারাপ। শারীরিকভাবে তিনি বেশ অসুস্থও। কিছুদিন আগে ডাক্তার দেখাতে ভারতে গিয়েছিলেন। নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফিকে আমরা চিনি জানি পনের বছর। মূলত পাকিস্তানের পিন্ডি এক্সপ্রেস খ্যাত শোয়েব আখতারের ধারায় নড়াইলের কৌশিকের নাম হয়ে যায় নড়াইল এক্সপ্রেস। দু’জনেই গতির রাজা। কিন্তু দেশের জন্যে মাশরাফির সংগ্রাম বৃত্তান্ত খুব কমই এসেছে মিডিয়ায়। গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে এডিলেইড অভিযানে সিডনি থেকে এডিলেইড পর্যন্ত মাশরাফির বাবা আর আমি একসঙ্গে যাই। ওই সময়ে তাঁর মুখে শুনি মাশরাফি বৃত্তান্তের খুঁটিনাটি। ছেলেবেলায় ব্যাট হাতে পাবার আগে উঠোনে স্যান্ডেলকে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলতো কৌশিক। এরপর মাশরাফি হয়ে ওঠার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু ইনজুরি ছিল এই গতি মানবের সঙ্গী। ইনজুরি থাকা স্বত্ত্বেও পেইন কিলার খেয়ে ইনজেকশন নিয়ে দুই পা গোপন ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে কিভাবে দেশের জন্যে খেলতে হয় এর একমাত্র দৃষ্টান্ত মাশরাফি। এমনভাবে ঝুঁকি নিয়ে সাধারনত পেশাদার ক্রিকেটাররা খেলেননা। কিন্তু মাশরাফিতো সব সময় খেলেন-খেলেছেন দেশের জন্যে। ইনজুরিকে তাঁর মতো তুচ্ছজ্ঞান আর কে করতে পারে! ২০০৯ সালে তাঁকে প্রথম তাঁকে প্রথম অধিনায়ক করা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। কিন্তু টেস্টের তৃতীয় দিনেই ইনজুরিতে পড়ায় তাঁর আর ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেয়া হয়নি। ২০১০ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড সফরে দ্বিতীয় ম্যাচেই জয় পায় বাংলাদেশ। আবার ইনজুরি তাঁকে ছিটকে দেয়। ২০১৫ সালে মাশরাফির নেতৃত্বে বিশ্বকাপে সেমি ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইন্যাল খেলে। কিন্তু এরপর বিসিবি বসের চাপের কারনে ২০১৭ সালে তাঁকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়তে হয়। অথচ তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে। ৮৭ টি ওয়ানডে ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। জয় পেয়েছেন ৪৯ টিতে। বাংলাদেশ দলকে বিদেশের মাটিতে যখন কাছে থেকে দেখেছি তখন মাশরাফি চরিত্রটি দেখেছি। এ দলে তিনি শুধু ক্যাপ্টেন না, দলে তিনি খেলোয়াড়দের ভাই-বন্ধু এবং অভিভাবক। বিরল এক নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর তাঁকে এক রাজনৈতিক পক্ষ পছন্দ করেনা। কিন্তু এমপি হবার আগে থেকে নড়াইলের মানুষের জন্যে তিনি নীরবে কাজ করে আসছেন। এক ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড এম্বেসেডর মাশরাফি। এদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে প্রতিবছর তাঁর সুপারিশকৃতদের চাকরি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। ঢাকায় মাশরাফির বাসা, নড়াইলের বাড়ি যারা গিয়েছেন তারা জানেন ‘কেউ ফেরেনা খালি হাতে’ সেখান থেকে। সবাইকে খেয়ে আসতে হয়। মাশরাফির আয়ের সিংহভাগ এভাবে প্রতিদিনের সাহায্যপ্রার্থীদের পিছনে ব্যয় হয়ে যায়। একবার নিউজিল্যান্ড সফরের সময় মাশরাফি বললেন তিনি বাড়ি গেলেই মুরব্বিরা তাঁকে এমপি হতে বলে। গত নির্বাচনে মাশরাফি তাঁর এলাকার যে পথ দিয়ে গেছেন সে দিকেই মানুষের ঢল নেমেছে। খেলায় যেমন তিনি অন্তঃপ্রান ছিলেন সর্বক্ষন, এমপি হিসাবে জনসেবাতেও সমান অন্তঃপ্রান। কোন দল দেখে তিনি এলাকার মানুষের জন্যে কাজ করেন এমন কেউ বলতে পারেনি। কিন্তু জাতীয় দলে মাশরাফি কেন বিসিবি বসের কাছে ‘সমস্যা’ হয়ে উঠেছিলেন তা বিস্তারিত আরেকদিন লিখবো। সাকিব দলে নেই। মুশফিককে বিসিবি বস পছন্দ করেননা। এই সময় ক্রিকেটারদের ভাই-বন্ধু-অভিভাবক মাশরাফির বিদায় দলে এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। মাশরাফিকে ভালোবাসি। বাংলাদেশ মাশরাফিকে ভালোবাসে। কারন মাশরাফি বাংলাদেশকে যা দিয়েছেন তা আর কেউ দেয়নি। মাশরাফিও আমাদের বিজয় আর গৌরবের নাম। আরেকজন মাশরাফিকে পেতে আমাদের আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। সেই অনেক দিন কত দিনে হবে তা কেউ জানেনা। অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বের শেষ ওয়ানডের স্বাক্ষী সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দর্শকদের অভিনন্দন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা