ফজলুল বারী
কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার পর হঠাৎ করে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। তেলের দাম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা। আমেরিকা একটি যুদ্ধবাজ দেশ। আমেরিকানরা যুদ্ধ পছন্দ করেন। এরজন্যে আমেরিকার অভ্যন্তরীন নানা পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি সরাতে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন দেশটির শাসকরা। টাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনের সঙ্গে এই ঘটনার যোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যে যখন যা খুশি করতে পারে এর কারন সৌদি আরব সহ মুসলমান দেশগুলোর বেশিরভাগ তাদের পদলেহনে পটু। সাংবাদিক আদনান খাসোগিকে হত্যার পর সৌদি যুবরাজ এখন আরও বেশি অনুগত আমেরিকার। মুসলিম দেশগুলো অনৈক্য আমেরিকার অনুকূলে। একটিমাত্র দেশ আছে ওই অঞ্চলে যে আমেরিকার অনুগত নয়, সেই দেশ ইরানকে কাসিম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে এক রকম যুদ্ধের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে, আয় আয় যুদ্ধ করি আয়! ইরান কী এই আমন্ত্রন গ্রহন করবে? এই মূহুর্তে যুদ্ধকে না বলা ইরানের পক্ষে কঠিন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ইরান এই যুদ্ধে জড়াবেনা। কারন শিয়া প্রধান দেশটার নেতাদের বুদ্ধিশুদ্ধি অন্য মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে কিছুটা ভালো।
আজকের ইরানকে আমরা আয়াতুল্লাহ খোমেনি-খামেনিদের দেশ হিসাবে জানলেও একই সঙ্গে জানি সমৃদ্ধ ইরানি চলচ্চিত্র-সাহিত্যের কারনে। বাংলাদেশ অঞ্চলে এক সময় ইরানি মেয়েরা চশমা বিক্রি করতে আসতেন। সেই সময় পেরিয়ে স্রোতের বিপরীতে থেকেও পারস্য অঞ্চলে ইরান অন্যতম এক অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি। সাদ্দামের পতনের পর সারা ইরাক ঘুরে বেড়ানোর সময় ইরানকে বোঝারও চেষ্টা করেছি। সাদ্দামের সঙ্গে ইরানি শাসকদের সম্পর্ক ভালো ছিলোনা। সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বতো ছিলোই। সুন্নি সাদ্দামের হাতে নির্যাতিত ছিল ইরাকের সংখ্যাগুরু শিয়া গোষ্ঠী। কিন্তু সাদ্দামের পতনের পর ইরানি নেতৃ্ত্ব খুশি হতে পারেনি, কারন বাগদাদ নিয়ন্ত্রনের নেতৃত্বটি আমেরিকার। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের জন্যে বিপদের কারন হতে পারে এমন সব নেতৃত্বকে একে একে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে আমেরিকার উদ্যোগে। আগে শুধু মিশর-জর্দান ছিল আমেরিকার টিয়া পাখি-ময়না পাখি। গোটা অঞ্চলে এখন ইরান আর ফিলিস্তিনের হামাস আর লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী ছাড়া তেমন কেউ আর যারা ইসরাইলের জন্যে হুমকির কারন হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য সহ দুনিয়ার আর সব মুসলিম অঞ্চলে এখন সবাই আমেরিকা জিন্দাবাদ।
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ-ইসরাইল যুদ্ধের নিউজ করতে লেবানন গিয়ে দেশটার নানাকিছুতে ইসরাইলি প্রভাব দেখে চমকে উঠি। হারিরির নেতৃত্বে লেবানিজ সরকার প্রো আমেরিকান তথা প্রো ইসরাইলি। তাই যুদ্ধটা লেবানন সরকারের সঙ্গে চলছিলোনা। যুদ্ধ চলছিল হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের। হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী শিয়া মতালম্বী। লেবাননে এক সময় গৃহযুদ্ধ লেগে থাকতো। গৃহযুদ্ধের অবসানে পরে দেশটি সংবিধান পাল্টে বিবদমান তিনগোষ্ঠীকে একীভূত করে। সুন্নি প্রধানমন্ত্রী, খ্রিস্টান প্রেসিডেন্ট এবং শিয়া স্পিকার। ২০০৬ সালের যুদ্ধ হিজবুল্লাহর সঙ্গে হওয়ায় প্রতি রাতে ইসরাইলি যুদ্ধ বিমান এসে বৈরুতের শিয়া এলাকাটির প্রতিটি ভবন ধংস করে দিত। এভাবে পুরোটা ধংস করার কাজ শেষ হবার পর জাতিসংঘের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বৈরুতের সুন্নি সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমন নানান জরুরী সার্ভিসের মধ্যে গিজগিজ করতো ইসরাইলের বেতনভূক্ত চর।
এমন নিয়ন্ত্রিত ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে কাসিম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে আমরা সবাই সোচ্চার। আমেরিকাও সোচ্চার। মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত মানবাধিকার সংগঠন সমূহ প্রতি বছর এমন হত্যাকান্ডের হিসাব নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্যে সুপারিশ করে। কিন্তু আমেরিকা যখন আরেক দেশে ঢুকে একই কায়দায় হত্যা করে সেটি হয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সোলাইমানিকে হত্যার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যুদ্ধ বন্ধের জন্যে এই হত্যাকান্ড। সোলাইমানি বেঁচে থাকলে যুদ্ধ হতো। এই হত্যাকান্ডে ইরানের প্রতিক্রিয়া প্রমান করেছে সোলাইমানির গুরুত্ব। ইরান বলেছে তারা এর প্রতিশোধ নেবে। অনেক লাশ দেখা যাবে মার্কিনিদের। আসলে কী তাই? আমার মনে হয়না। কারন এতে ইরাকের মতো ইরানও ধংস হয়ে যাবে।
ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে কুয়েত থেকে ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়ে ইরাকের সব ট্যাংক ও যুদ্ধাস্ত্র ধংস করা হয়। এরমানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহু্জাতিক বাহিনী যখন ইরাকে ঢুকে তাদের কোন প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি। এখন ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র সহ যুদ্ধাস্ত্র কী আছে না আছে তা নিয়ে নানান হিসাব দেয়া হলেও ইরানের যুদ্ধ করার শক্তি আমেরিকার মতো নয়। কারন যুদ্ধ করতে গেলে একই পরিনতি ভোগ করতে হবে ইরানকে। ইরান যে ঠান্ডামাথার দেশ, সাদ্দামের মতো মাথামোটাদের দেশ নয় তা এর আগেও নানা উত্তেজনার সময় দেখা গেছে। কিন্তু এই ঘটনা আমেরিকাকে নতুন যে বার্তা দিলো তাহলো, মার্কিন নিয়ন্ত্রনাধীন ইরাকের ভিতরেই ইরানের শক্তি। কারন এই ইরাক শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ। নাজাফ-কুফা-কারবালা হযরত আলী, ইমাম হোসেন-হাসানের প্রায় সব স্মৃতি চিহ্ন এখন ইরাকেই। যে সব শিয়াদের তীর্থ। কাজেই যুদ্ধ না হলেও গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন মার্কিন নাগরিকরা। আমেরিকার যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্টদের কারনে দুনিয়ার পর্যটন স্পটগুলোয় এখন আর আমেরিকানদের পাওয়া যায়না। সোলাইমান হত্যা আমেরিকানদের পর্যটন জীবনকে আরও সংকুচিত করতে পারে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা