নিজ ডিপার্টমেন্টে চেয়ারম্যান স্যার এবং অন্যদের সঙ্গে গীতা।
আমি যখন এটা শুনেছি তখন আমি অনেক খুশি হয়েছি। দশ বছর পর একটা সাফল্য। আমি এই খবরটা প্রথম আমার আম্মুকে জানাই। উনি শুনে অনেক খুশি হয়েছেন। বললেন, দশ বছর অনেক মেহনত করেছ, অনেক কষ্ট করেছ। সেই কষ্টের তুমি ফল পাচ্ছ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোডন্টিক্স বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনকারি হওয়ায় এবছর গোল্ড মেডেল বিজয়ী গীতা পাকুরেল (Geeta Pyakurel) নিজের এওয়ার্ড প্রাপ্তির পর এভাবেই মায়ের কাছ থেকে শুভাশীষ পান।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমবার ২০০৬ সালের এপ্রিলে আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্সের জন্য বাংলাদেশে আসি। প্রথমে সিটি ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হই। সেখানে পাঁচবছরে গ্রাজুয়েশন শেষ করি। এরপর দেশে চলে যাই। ২০১৩ এ এমএস (অর্থোডন্টিক্স) কোর্সে ভর্তি হই। এই কোর্স শেষ করে বাড়ি যাই। এই প্রোগ্রামের খবর পাবার পর এবার এসেছি।’
‘আমার যে পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল হয়েছে, এটা আমি জানতে পারি যখন মার্কশীট আসে ইউনিভার্সিটি থেকে। তখন আমাকে বলে যে, তোমার ভাল মার্কস হয়েছে। তুমি পাস করেছ। তখন আমি এই এওয়ার্ডের কথা আমি জানতাম না তখন। পরে ডিপার্টমেন্ট থেকে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে বলেছিলেন এই বছর তুমি এই এওয়ার্ডটা পেতে পার।’ – বলেন গীতা।
খবরটি শোনার পর তার ভীষণ ভাললাগা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি যখন এটা শুনেছি তখন আমি অনেক খুশি হয়েছি। দশ বছর পর একটা সাফল্য। আমি এই খবরটা প্রথম আমার আম্মুকে জানাই। উনি শুনে অনেক খুশি হয়েছেন। বললেন, দশ বছর অনেক মেহনত করেছ, অনেক কষ্ট করেছ। সেই কষ্টের তুমি ফল পাচ্ছ।’
‘এরপর ইউজিসি থেকে আমাকে মেইল করেছিল। তারা একটি ফর্ম পাঠিয়েছিল সেগুলো পূরণ করে দিয়েছি। তারপরে এই প্রোগ্রামের ডেট ঠিক করল। তারপরে চলে আসলাম।’
‘আমাদের রিহার্সাল ছিল ২৫ তারিখ। ঐ দিন আমি দুইটার দিকে গিয়েছিলাম। এরপর ২৬ তারিখে তারা ১০টায় প্রােগ্রাম শুরু করেছে। প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে ১২টার দিকে।’ – বলেন গীতা।
এটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে গীতা বলেন,’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুধু টিভিতে দেখেছি। এবার সরাসরি তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। আমার যখন নাম ঘোষণা হয়, আমি যখন মেডেল নিতে যাই, ইউজিসির অফিসাররা বলছিল, ও নেপালী! ও কনগ্রাচুলেশন, কনগ্রাচুলেশন! তারপর বলছিল, নেপালী। আমার খুব ভাল লাগছিল কারণ এটা তো আমার সেকেণ্ড হোম।’
‘আমার পরিবারের সদস্যরা জানে। বাইরের কাউকে নেপালে এখনও কিছু জানাইনি। সেখানকার অর্থোডন্টিক্স সোসাইটি আছে। তারা ফেসবুকে আমার ছবি দেখেছে। দেখে তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে ছবি দেয়া হয়েছিল সেটা দেখে উইশ করেছে। ও ‘নেপালের ডটার’। এটা ‘নেপালের প্রাইড’ বলে কমেন্ট করছে।’
ছোটবেলার স্বপ্ন এখন পূরণ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার ছোটবেলা থেকেই ডক্টর হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম ডক্টর হবো। আর আমার বোন ছিল, সে বলত আমি বড় হয়ে পাইলট হবো। পরে, আমার বোন পাইলট হয়েছে। আমি ক্লাস এইটে যখন পড়তাম তখন থেকে আমার মনে হয়েছে আমি ডেন্টিস্ট। তখন থেকেই আমি ডেন্টিস্ট। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল। আমার পড়াশোনা মোটামুটি ভালই ছিল। এইত পড়তে পড়তে এইখানে পৌঁছালাম। ভালভাবে পাস করব। পড়াশোনা করব এটা ছিল, কিন্তু এটা তো আমি জানতাম না যে গোল্ড মেডেল পাব!
আমি স্কুলে সবসময় ফার্স্ট, সেকেণ্ড, থার্ড হইতাম।
তাহলে আমরা বলতে পারি, আপনার জীবনের লক্ষ্যটা পূরণ হয়েছে? ( হাসি দিয়ে) হ্যা ছোটবেলা থেকেই। এখন আমি অর্থোডন্টিক্স’র আলাদা বিশেষজ্ঞ।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিয়ের দিন গীতা।
পরিবার সম্পর্কে গীতা বলেন, ‘আমরা পাঁচবোন দুই ভাই। আমি চতুর্থ। বাবা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, মা গৃহিনী। নেপালের কাঠমুন্ডুতে বাড়ি। আমাদের নেপালে আগে মেয়েদের পড়াশোনার গুরুত্ব দিতনা। অনেক আগে এটা ছিল। এখন আর সেই জিনিসটা নাই। এখন ছেলে মেয়ে সবাই সমান।
প্রিয় ছাত্রীর এই সাফল্যে প্রিয় শিক্ষকেরা অনেক খুশী উল্লেখ করে গীতা বলেন, ‘আমি এওয়ার্ড পাবার পর ডিপার্টমেন্টে গেছি কিন্তু ব্যাচমেটদের সাথে এখনও কন্টাক্ট করিনি। তারা ফেসবুকে আমাকে উইশ করেছে। আমিও রিপ্লাই করেছি। কিন্তু সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিনা। সময়টা মিলছে না। এত কাজের মধ্যে সুযোগ পাইনি। ডিপার্টমেন্টে গেছি। স্যারেরা অনেক খুশি হয়েছে। চেয়ারম্যান স্যার, তার পরিবারসহ আমার ভাইকে, আমাকে নিয়ে আমরা খেতে গেছিলাম। স্যারের চেম্বার থেকে স্যার সবাইকে নিয়ে, স্যারের মেয়ে, সবাই খুব খুশি হয়েছে।’
বাংলাদেশে পড়তে আসার সুযোগ কিভাবে হলো। সেখানে প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের তখন বলেছিল এখানে অনেক ভাল ভাল ইউনিভার্সিটি আছে। আমি সার্চ দিয়ে দেখলাম বাংলাদেশ কেমন? খাবার দাবার অন্য সবকিছু। তখন দেখলাম অনেকটা মিল আমাদের সাথে। তারপরে ভাল লাগল। এরপর এ্যাপ্লাই করলাম। এভাবেই বাংলাদেশে পড়তে আসা। সরাসরিই ভর্তি হয়েছে।’
‘সিটি ডেন্টাল কলেজে আমি ১১তম ব্যাচে ছিলাম। আমাদের স্যাররা নেপালি হওয়ায় আলাদা যত্ন নিত।’
হোস্টেল চেয়ে সহজেই পেয়ে যাই উল্লেখ করে গীতা বলেন, বিএসএমএমইউতে যখন আমি ইন্টারভিউ দিতে আসলাম। তখন এটা ফাইভ ইয়ার কোর্স হয়েছে। আগে ছিল থ্রি ইয়ার কোর্স। এই ফাইভ ইয়ার কোর্সে আমি প্রথম ছিলাম। এর আগে একজন ডেন্টিস্ট ছিল উনি ছেড়ে চলে গেছিল। কন্টিনিউ করে কমপ্লিট করলাম আমি প্রথম বিদেশী নারী। ইন্টারভিউতে স্যাররা বলেছিল, তুমি কি থাকতে পারবে? তখন আমি বলেছি, আমি তো একা আছি। আমি হোস্টেল পেলে থাকতে পারব। বাইরে হলে থাকতে পারব না। তখন স্যাররা বলেছিল, আচ্ছা ঠিক আছে আমরা তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। এটা আমার অনেক ভাল লাগে। তখন আলী আজগর মোড়ল স্যার তখন হল প্রোভোস্ট ছিলেন। গাজী স্যার ছিলেন, উনারা বলেছিলেন যে ব্যবস্থা হবে।’
‘আমি ডিপার্টমেন্টে সবার ছোট ছিলাম। আমাকে ভাইয়ারা-আপুরা খুবই আদর করত। আমি সবসময় সবার আদর পেয়েছি। কোন অসুবিধা হয়নি। সবাই আমাকে ছোটআপু বলত। আমাদের ডিপার্টমেন্টের পরিবেশটা এমনি অনেক ভাল।’ – বলেন গীতা।
অসুস্থতার কারণে সঙ্গে আব্বু-আম্মু আসতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার আব্বু-আম্মুর আমার সঙ্গে আসার কথা ছিল। আব্বুর এনজিওপ্লাস্টি করা হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে । তার ৮০ ভাগ ব্লক। আমি গত কয়েকদিন আব্বুকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। আব্বু আম্মু আসতে চেয়েছিল ওরা আসতে পারেনি। এজন্য তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছি আমি। নাহলে আরও কিছুদিন থাকতাম। আর দুদিন থাকলে আমি স্যারদের সঙ্গে দেখা করতাম। ব্যাচমেটদের সঙ্গে দেখা করতাম কিন্তু এখন পারছিনা। এখন আব্বুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তার লাংসের মধ্যে পানি জমেছিল এটা এখন কম হয়েছে।’
তিনি বলেন, আমার মূল প্রায়োরিটি হচ্ছে আমার রোগী উল্লেখ করে গীতা বলেন, ‘আমার রোগীকে ভালভাবে প্রায়োরিটি দেয়াই আমার কাজ। আমি এখন নেপালে প্রাইভেট কাজ করছি। সেখানে রোগী দেখছি। আমার হাজব্যান্ড এখন কানাডায় আছে, আমাকে কানাডায় চলে যেতে হতে পারে। তবে, আমি যেখানেই থাকি রোগীই হবে আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি।’
উল্লেখ্য, এবছর দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর বা সিজিপিএ অর্জনকারী ১৭২ শিক্ষার্থীকে (৮৮ জন ছাত্রী ও ৮৪ জন ছাত্র) ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ দেয়া হয়। এদের মধ্যে গীতা একজন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা