আশীষ কুমার দে : যে বিষয় নিয়ে লিখছি, এমন বিষয় নিয়ে লিখতে হবে আগে কখনও ভাবিনি। অত্যন্ত দু:খ ও বেদনার সঙ্গেই লিখতে হচ্ছে। তাই শিরোনামেই আগেভাগে দু:খ প্রকাশ করে নিলাম।
পাঠকনন্দিত অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনে আজ (২১ জানুয়ারি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে; যার শিরোনাম ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেলের কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন’। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি একাধিকবার পড়ে আমি বিষ্মিত, হতবাক, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি।
দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে দেশি-বিদেশী অনুদানবিহীন বেসরকারি সংগঠন ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতির কর্ণধার (মহাসচিব) মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও পরিবহন ব্যবসা নিয়ে লেখা হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, মোজাম্মেল চট্টগ্রামের চন্দনাইশে পৃথক চারটি দলিলের মাধ্যমে মোট ৩৪৫ শতাংশ (১০ দশমিক ৪৫ বিঘা) জমি ক্রয় করেছেন। দলিলগুলো রেজিস্ট্রি হয়েছে গত বছরের ২৩ জুন থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় ‘ফাতেমা মোটরস’ নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশার একটি শোরুমও রয়েছে তার; যেখানে অটোরিকশা বিক্রি করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে নম্বরপ্লেটবিহীন বেশকিছু সিএনজি-অটোরিকশা চলাচল করে; যেগুলোর গায়ে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সাংবাদিক সমিতি’ এবং ‘সাংবাদিক’ মোজাম্মেল হক চৌধুরী’, মোবাইল: ০১৫৫৪-৩২৪৫০৩।
তবে তিনি কোন পত্রিকা কিংবা অনলাইন নিউজপোর্টালের সাংবাদিক, সে পরিচয় সেখানে উল্লেখ নেই বলে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনে বাংলা ট্রিবিউন আরো জানায়, মোজাম্মেল হক গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের বোয়ালিয়া উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে জামানত হারিয়েছিলেন। এছাড়া তার স্ত্রী একবার ইউপি সদস্য পদে দাঁড়িয়ে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৩০টি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী নামের এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব বেশি দিনের পরিচয় না।
২০১৪ সালের মে মাসে পদ্মায় একটি লঞ্চডুবির পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে একটি ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নৌ দুর্ঘটনাবিরোধী মানববন্ধনের জন্য।
ওইদিন একই স্থানে সকাল ১০টায় একই বিষয়ে যৌথভাবে মানববন্ধন ও বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করেছিল নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, সিটিজেনস রাইটস মুভমেন্ট, গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশ (জিসিবি) এবং পিস। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমিও ছিলাম সেখানে।
এরপর ভদ্রলোককে কোনোদিন নৌখাত তথা নদ-নদী রক্ষা, নৌ দুর্ঘটনা রোধ ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত কোনো কর্মসূচিতে দেখিনি।
তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে পরিচিতির উত্থান ঘটতে থাকে মোজাম্মেল হক চৌধুরীর। তিনি হাজির হন ২০১৪ সালের সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ফিরিস্তি নিয়ে। মিডিয়াগুলো সেই ফিরিস্তি ফলাও করে প্রচারের সুবাদে তিনি সারা দেশে পরিচিত হয়ে যান এবং বিভিন্ন মহলে সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী আন্দোলনের নেতা, গবেষক ইত্যাদি হিসেবে অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান।
এ ছাড়া গত কয়েক বছর যাবত তিনি বছরে তিন থেকে চারবার তিনি সংবাদ সম্মেলন করে পত্রিকা ও টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচার পান। বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও মাঝেমধ্যে আমন্ত্রণ পান তিনি।
তবে মোজাম্মেল হকের প্রতিটি কর্মসূচিতে সমাজের অনেক নামিদামি ব্যক্তি (সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ) উপস্থিত থাকেন। ফলে খুব সহজেই তিনি হয়ে ওঠেন সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যমণি!
এছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চাঁদাবাজির মামলায় মোজাম্মেল হক ঢাকার মিরপুর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তার স্ত্রী দাবি করেন, মোজাম্মেল একজন সাংবাদিক এবং ওই পত্রিকার বেতনে তাদের সংসার চলে, নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে বাসা ভাড়া দেয়া হয়।
যদিও আমি নিজে এই ঢাকা শহরে ১৯৯৯ সাল থেকে একজন সক্রিয় গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না, মোজাম্মেল কোন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল কিংবা সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক।
তবে তিনি আমার শত্রু নন; আবার বন্ধুও নন। দেখা হলে হাসিমুখে পারস্পরিক আলাপ-চারিতা চলে। ফোনেও কখনও কখনও আলাপ হয়। গত ১৮ জানুয়ারি শনিবার সকালে মোজাম্মেল হোসেন আমার অফিসে বেড়াতে এসেছিলেন এবং দীর্ঘক্ষণ ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপও হয়।
কিন্তু আজ তাঁর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি দেখে আমি বিষ্মিত, হতবাক, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। কারণ, আমিও সামাজিক আন্দোলনের একজন কর্মী। ভোরের কাগজে সাংবাদিকতা করার সময়ে ২০০৫ সাল থেকে প্রথমে নৌ দুর্ঘটনাবিরোধী কার্যক্রম শুরু করি; যা আজও অব্যাহত আছে। পরবর্তী সময়ে সড়ক ও রেল দুর্ঘটনাকে আমার বা আমাদের কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসি।
ঢাকার গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে গঠন করি শিপিং এন্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ); বর্তমানে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, শিশুসংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠন করেছি নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি; যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুর রহীম (প্রয়াত)। আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।
এছাড়া গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশ (জিসিবি) নামে একটি গবেষণাধর্মী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও আছে আমার কাধে।
তবে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং জিসিবির কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারি না। কারণ হলভাড়াসহ অন্যান্য খরচ যোগানো বা সংগ্রহ করা খুবই কষ্টকর।
শুধুমাত্র নিত্যদিনের সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ, সেগুলো পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো- এসব কাজে ব্যবহার করা হয় অনলাইন নিউজপোর্টাল পিটিবিনিউজবিডি.কমের অফিস। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের দুটি কম্পিউটারও ব্যবহার করা হয় এসব সংগঠনের কাজ।
তাই আজ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদনটি দেখার পর থেকে বিশ্বাসই করতে পারছি না যে, প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যগুলো সঠিক! আবার অবিশ্বাস করাও সম্ভব নয়।
যদিও তিনি বাংলা ট্রিবিউনের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে নিজের দোষ খন্ডনের চেষ্টা করেছেন। তবে একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মোজাম্মেলের বক্তব্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
যাই হোক, মোজাম্মেল হক চৌধুরী যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং আমি নদ-নদী রক্ষাসহ নৌ, সড়ক ও রেল দুর্ঘটনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় এবং সব ধরনের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরব, সেহেতু তার এবং আমার কাজের মধ্যে দৃশ্যত অনেকটা মিল রয়েছে। তবে মিলটি গুণগত কি-না, তা নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান।
তবে, মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদটি আমার কাছে, আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত। প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যসমূহ সত্য নয়, তা মনে করি না; কারণ বাংলা ট্রিবিউন সবসময়েই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। অন্যদিকে তথ্যগুলো সত্য, তা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।
কারণ সামাজিক আন্দোলনের একজন কর্মী বা সংগঠক এতোটা অসৎ হবেন, তা কল্পনাও করতে পারি না। তাই আমি মনে করি, এ বিষয়ে একটি তদন্ত হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেহেতু অভিযোগটি অর্থ-সম্পত্তিবিষয়ক, সেহেতু বিষয়টি তদন্তর জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হলো- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাই রাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এ বিষয়ে সত্বর কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে প্রত্যাশা করি। এর ব্যতিক্রম হলে আমার বা আমাদের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় থেকে যাবে।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে জনাব মোজাম্মেল নির্দোষ প্রমাণিত হোক- এটাই আমার প্রত্যাশা। কিন্তু রিপোর্টে যেসব সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছে তাতে পার পাওয়া আদৌ সম্ভব?
তবে মোজাম্মেল দোষী প্রমাণিত হলে তার কঠোর শাস্তিও দাবি করছি।
# আশীষ কুমার দে সম্পাদক, পিটিবিনিউজ.কম ও সাপ্তাহিক পাঠকের কণ্ঠ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা