বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আর মাত্র ১২ দিন বাকি। চলছে ক্ষণগণনা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং তাকে নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর গোলাম রহমান। তিনি লাল সবুজের কথা’কে বলেন, আমরা তো বঙ্গবন্ধুকে জানি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে । বিবিসির জরিপে তাকে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। সেই হিসেবে বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্ব্য। যে কারণে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তার মানে তিনি হিমালয় সাদৃশ্য মানুষ ছিলেন ।
বঙ্গবন্ধু একজন মহান ব্যক্তিত্ব্য, মহান রাষ্ট্রনায়ক, মহান রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি একজন বিশ্বনেতা নেতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা অর্থনৈতিক অবস্থা, বাংলাদেশে খাদ্যাভাব, এগুলো দূর করতে কাজ করছেন, অর্থনৈতিক ধীর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং সবকিছু মিলে বাংলাদেশের উপর নানানভাবে আঘাত আসে। যে আঘাতটা আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে দিল। আমাদের যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, সেই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করল।
আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, উনার প্রতি বিভিন্ন সময়ে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, কেন যেন তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিভিন্ন প্রকার চেষ্টা চলেছে। তার বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে এবং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। এর ফলে, ৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ করার পর, ৬৯ এ যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো, এমনকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন যখন শুরু হয়ে গেল তখন তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো।
কিন্তু আসলে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব্যকে ইচ্ছে করলেই কোন শক্তি বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে না এটাই প্রমাণিত হয়েছে বারবার। যে কারণে বঙ্গবন্ধু তার স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছেন। এ কারণেই এতবড় মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পরে যে বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারালাম সেই বঙ্গবন্ধুর শক্তিমত্তা কিম্বা তার যে ভাবমূর্তি সেটা কিন্তু ধীরে ধীরে আবার জনগণের মধ্যে পরিস্ফূটিত হয়েছে। সে আবার মানুষের কাছে এসে জাগরিত হলো। এই যে, বঙ্গবন্ধুর যে ভাবধারা, আদর্শ এবং তার যে প্রতীক বঙ্গবন্ধু যে কত বড় এটা আমরা দেখেছি।
আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তখন গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন হয়েছে, জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয়েছে। এই সবগুলো বিষয়কে একসাথে করে আমরা দেখি বিশ্বে একটা সমাজতান্ত্রিক মুভমেন্ট দেখা গেছে। সেটা খুব জনপ্রিয় মুভমেন্ট হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তখন দেখা যায়, যে কোন দেশের সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য সমাজবিপ্লবের প্রয়োজন হয় কিন্তু বাংলাদেশ কিন্তু সেই অর্থে শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
বাংলাদেশে এ সময় ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পের ততটা বিকাশ হয়নি। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং বাংলাদেশে একটা অধনতান্ত্রিক বিকাশ ধারা ছিল। সেই বিকাশটাকে ত্বরান্বিত করে গণতান্ত্রিক বিকাশের কাছের একটা জাতীয়ভাবে উন্নয়নের কাঠামো নতুন করে চিন্তা করা হয়েছে। সেটা সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সেই আন্দােলনটা ছিল। তখন এই আন্দোলনটা বিশ্বে একটা নাড়া দিয়েছিল। বিশ্বে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।
যে কারণে পলিটিক্যালি যারা ওয়েস্টের রাজনীতিবিদ কিম্বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারা রাজনীতিতে, ক্ষমতায় ছিলেন তাদের তৎপরতা দেখা যায়। তারা সেইসময় এই অধনতান্ত্রিক জায়গা থেকে কুক্ষিগত করার জন্য বাংলাদেশে এক ধরণের ষড়যন্ত্র করে এবং সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে উৎখাতের চেষ্টা করা হয়। সুতরাং আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু যে আদর্শে, যে চিন্তা চেতনায় কিম্বা জনগণের মানসম্পন্ন জীবন-যাপনের যে প্রচেষ্টায় ব্যপ্ত ছিলেন সেই বিষয়গুলো কিন্তু অনেক বড় করে দেখা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্যই রাজনীতিতে পদার্পন করেছেন। তিনি সেগুলো বাস্তবায়ন করছেন।
একসময় প্রাথমিকের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হলো এবং প্রাইমারি শিক্ষাকে জাতীয়করন করা হলো। বঙ্গবন্ধু তখন অনেক বড় একটা অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে এই কাজটি করলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয় বেতন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসলেন। নারী শিক্ষার ব্যাপারে, উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে সবসময় বঙ্গবন্ধুর একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যাতে করে আমাদের দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং অসাম্প্রদায়িক একটা প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। তার জন্য তার একটা প্রচেষ্টা ছিল। সেই হিসেবেই কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং সেইভাবে শিক্ষাকে সাজানো হচ্ছিল এবং শুধু শিক্ষা নয় প্রতিটি স্তরে, অন্যান্য সেক্টরগুলোতেও একইভাবে তার দূরদর্শী চিন্তা চেতনার যে রাজনীতি সেটাই কিন্তু চালু ছিল।
সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে যদি আজকে পাঠ করতে হয়, বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হয় তাহলে এই বিষয়গুলো অনেক বেশি গভীরভাবে জানা যাবে।
প্রতিটা বিষয় জানার জন্য, বঙ্গবন্ধু যে একজন বিশিষ্ট মানুষ, বিশিষ্ট মানবতাবাদী, একজন মহান ব্যক্তিত্ব্য এটাকে কিন্তু উপস্থাপন করার কিম্বা এটাকে অনুসন্ধান করে আমাদের হৃদয়ঙ্গম করার কিম্বা আমাদের বোঝার জন্য যথেষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করা উচিত। তাকে চর্চা করা উচিত। কিন্তু সেই জায়গাটায় আবার আমরা জাতীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতিক আদর্শের দিক থেকে মেনে নেইনি। অনেক রাজনৈতিক দল যারা এই বিষয়টাকে মেনে নেয়নি এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দেশে যে যুদ্ধ হয়েছে এই ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে সেইভাবে তারা মূল্যায়ন করে না। আমার মনে হয়, এই জায়গায় আমাদের জাতীয় ঘাটতি বা স্খলন রয়েছে। ঘাটতিটা হচ্ছে আমরা জাতীয়ভাবে আমাদের নেতাকে মূল্যায়ন করতে শিখি নাই।
দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে একসাথে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করবো এই পরিবেশটা আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষক লীগের নেতা না। তিনি এই বাংলাদেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের এবং প্রত্যেক নাগরিকের নেতা। এই কথাটা আমরা (সাধারণত আওয়ামী লীগ) যেভাবে বিশ্বাস করি একটা গোষ্ঠি আছে তারা সেভাবে বিশ্বাস করেনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে যেভাবে অবদান রাখার কথা, তাদের আচরণ দেখে বোঝা যায়, তারা বঙ্গবন্ধুকে, তার রাজনীতিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হয়ত সেভাবে বিশ্বাস করে না।
সুতরাং আমার মনে হয় জাতির জন্য আজকে সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা হচ্ছে এটাই যে, বঙ্গবন্ধু যে সার্বজনীন, বঙ্গবন্ধু যে সবার নেতা, বঙ্গবন্ধু যে দেশ-কাল-পাত্র-সময় উত্তীর্ণ আমাদের বড় ধরণের গৌরব, এই গৌরবকে সবাই সমান করে ভাগ করে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা থাকা দরকার। আমার মনে হয়, আমরা এই ব্যাপারে সাফল্য লাভ করব। আমি আশাবাদী মানুষ। আমাদের সবার হৃদয়ে সমানভাবে বঙ্গবন্ধু চির জাগরুক থাকবে এটাই আশা করব।
সাক্ষাতকার গ্রহণ : তাসকিনা ইয়াসমিন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লাল সবুজের কথা ডটকম।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা