আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
৪৮ বছর পর বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে গেলে ৭১ এর কথা ওতোপ্রোতভাবে চলে আসে। যুদ্ধের শুরু, তারপরে শেষ, এরপর জয়ের প্রশ্ন। সেই সময় আনন্দ এবং জখম দুটোই মানুষকে ভুগিয়েছে। স্বাধীনতার আনন্দ, পেছনে ফেলে আসা নয় মাসের জখম।
মার্চের ২৫ তারিখ আমি ঘোড়াশাল এলাকায় থাকি। তখন আমি ঘোড়াশাল স্কুলের ছাত্র। নাইন থেকে টেনে উঠেছি। আমি ফার্স্ট বয়। ধারণা করা হয়েছিল ভাল ছেলে এবং সে এসব ঝামেলার মধ্যে যাবে না।
কিন্তু শুধু ২৫ তারিখেই ঢাকাতে এক রাতেই সাত হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এবং প্রথম সপ্তাহে ঢাকাতে ত্রিশ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে। অন্যান্য জায়গার পরিসংখ্যানগুলো…। এই পরিসংখ্যান দিয়েছে জাতিসংঘের একটি সংগঠন। তাদের পরিসংখ্যানে এটা ছিল। কিন্তু ঘোড়াশাল থেকে ঢাকার এই শব্দ বোঝা যেত না। হঠাৎ আমি টাইপ করা একটি কাগজে দেখতে পেলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সাদা কাগজে টাইপ করা এবং ম্যাসেজটা দিয়েছে ইপিআই – পাকিস্তান রাইফেলস। তাদের বঙ্গবন্ধুর সাথে তখন কমিউনেট হচ্ছিল। কোথা থেকে এই ম্যাসেজ এসেছিল এটা তখন যাচাই করার মতো অবস্থা ছিল না। যেকোন সময় পাকিস্তান আর্মি ঘোড়াশাল এলাকায় ঢুকে যেতে পারে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে আমি বাসা থেকে, যেটা হয় আর কি, পালিয়ে যাই। মার কথা তো শুনতে হয়। দেশ মা যখন ডাকে তখন মার কথার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। আমি তাকে বলি নাই, বলে তো যাওয়াও যায়না।
আমি নরসিংদী ক্রস করার সময় এয়ার এটাক হচ্ছিল। মেঘনা ক্রস করে মেঘনার ওইপারে হেঁটে হেঁটে কুমিল্লা যাওয়া যায়। তবে, সেটা অনেক দূর। আমি আমাদের গ্রামে পৌঁছাই। আমাদের গ্রামটা আগরতলা বর্ডারের কাছাকাছি। গ্রামে আসলাম এই কারণে যে গ্রাম থেকে চলে যাব। গ্রাম থেকে কিছুদিন পর আমরা কয়েকজন মিলে চলে গেলাম। আগরতলায় কংগ্রেস ভবনে গিয়ে উঠলাম। সেখানেই রাতে ফ্লোরে ঘুমাতে হয় ইট মাথায় দিয়ে। আমরা ওখানে তালিকাভুক্ত হলাম। ওখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে গেল। ত্রিপুরার পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর ক্যাম্প ছিল। এগুলো ট্রানজিট ক্যাম্প । আসলে রিসিপশন ক্যাম্প এগুলো। আমি এগুলো নিয়ে এখন বিস্তারিত বলব না। অনেকে এই ক্যাম্পগুলোর বিষয়ে কিছুই জানেনা। কারণ, তারা অস্ত্রেরই নয়, ক্যাম্পের নাম, যুদ্ধের নাম কিছুই বলতে পারেনা কিন্তু সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে।
ফলে, হচ্ছে কি, আমরা যাদেরকে চিনি এবং আমরা বলেছি জেনুইন ফ্রিডম ফাইটারদেরকে আইডেন্টিফাই করতে হবে। এটা শুধু আমাদের পরিচয় সংকটের জন্যই দরকার না, কে ফ্রিডম ফাইটার আর কে না সেটা নির্ধারিত হওয়াও দরকার। হাইকোর্টও সেই রকম ডিরেকশন দিয়েছে কে মুক্তিযোদ্ধা তা ঠিক করুন। যাই হোক, এগুলো আমাদের এখনকার কর্মকান্ড।
ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতে খুব কষ্ট হত। খাবার দাবারের কষ্ট। কষ্ট মানে, একটা ক্যাম্পে, ক্যাম্পটার নাম হাফানিয়া সেখানে যদি এক রোববারে খাওয়া দিত তাহলে পরের দিনের খাবার সিরিয়াল আসতে মঙ্গলবার হয়ে যেত। সুতরাং পেটের খিদায় লোকজন অস্থির হয়ে যেত। ত্রিপুরার একটা সুবিধা ছিল তুমি কম দামে কলা,২০ পয়সায় একটা কলা কিম্বা আট আনায় একটা কাঁঠাল পাওয়া যেত। কাঁঠাল খাওয়ার পরে যে বিচিগুলো থাকত সেগুলো চুলার মধ্যে দিয়ে অনেক ছেলেরা খেত, আমরাও খেয়েছি। ওখান থেকে অম্পি ট্রেনিং ক্যাম্পে গেলাম .. আগরতলা থেকে পাহাড়ি এলাকায়। খুব গভীর জঙ্গল। খুব সম্ভবত ৮৭ মাইলস। সেটা আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প।
ওখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার সময়, যেহেতু ঢাকা থেকে গেছি, আমি ভাল ছাত্র, তাই আমি ওখানকার আর্মি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম। যে কারণে হোক, আমার বয়সটা কম হওয়া সত্ত্বেও আমি সেখানে ভাল অবস্থানে ছিলাম। আমরা ছিলাম আলফা কমান্ডার। কমান্ডার মানে প্রশিক্ষক। প্রায় ২শ জনের দায়িত্বে ছিলাম। ওখান থেকে ট্রেনিং শেষ করে আমরা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকি নাই। কারণ যে এলাকায় আমার বা, নিয়ম হলো ওই এলাকাতেই গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমার বাড়ি হলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়।
যেখানে ভয়াবহ সংঘর্ষ লাগাতার ছিল। ফলে, আমাদেরকে মন্দবাগ সালদা নদী ফ্রন্ট লাইনে প্রথমে থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে কাজ করেছি। যেহেতু আর্মিদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ছিল, প্রশিক্ষণ যাতে আরো ডেভেলপ হয় সেটা চিন্তা করেই প্রথম থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের রেগুলার আর্মির সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে আমাদের। ওখানে কাজ করার পরে, ( আমি খুব সংক্ষেপে বলছি, পাখির চোখে দেখা যাকে বলে) সেখানে প্রত্যেকদিনই আমাদের কেউ না কেউ মারা যেত। ওটা ছিল একটা ফ্রন্ট লাইন উইথ দ্যা সাপোর্ট অব ফ্রন্ট লাইন। তখন আমাদের সামনে পাকিস্তানিদের অবস্থান। ওখানে প্রায়ই কেউ না কেউ মারা যায়। আমরা ইন্ডিয়া থেকে অর্থাৎ আগরতলা থেকে যারা ট্রেনিং করে আসি তাদের মধ্যে দুজন মারা যায়।
অল্প সময় পরে ফ্রন্ট লাইন থেকে আমি একটা প্লাটুনের দায়িত্ব পেলাম। রেগুলার ওয়ার ফেয়ার অর্থাৎ জনযুদ্ধ করার জন্য আমার থানা বুড়িচংয়ে ঢুকলাম। তো, এখানকার অনেক ঘটনা আছে। গোমতী নদীর পারে একটা সংঘর্ষ হয়েছিল। আমাদের অনেক মামুলী অস্ত্র, তাদের দামি অস্ত্র। যুদ্ধের নেরেটিভ তোমরা অনেক যায়গায় পাবে, কে কাকে কত রাউন্ড গুলি করল, কে মারা গেল। আমি বরং স্মৃতিচারণ করে যাই।
ওখানে একটা ঘটনা ঘটল, বিকেলে আমি আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে মুভ করছি তখন খবর পাওয়া গেল যে, আমার বড় ভাই, শেখ আওলাদ মারা গেছে। তিনিও ওয়ার ফ্লিডে ছিলেন। কোন যায়গায় মারা গেছে, শোনা গেল যে, আমাদের থানাটা বুড়িচং এর বাঞ্ছারামপুর উনি মারা গেছেন। বুড়িচং থেকে ব্রাক্ষ্মণপাড়া অনেক দূর। আমি সেই সময় সাইকেল নিয়ে প্রায় ৩০ মাইল, ইটের মধ্য দিয়ে, কাঠের পুল পার হয়ে, কাঠের পুলের উপর দিয়ে সাইকেল চালানো যায় না, সেইসময় পুরো বাংলাদেশেই কাঠের পুল ছিল। আমি গিয়ে শুনেছি আর কি, রুপসদী নদীতে তার ডেডবডি ফেলানো হয়েছে।
প্রথমে তার দুইটা হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে। তারপরের দিন তার দুইটা পা ভাঙে। তারপরের দিন — বেয়নেট চার্জ করে তাকে নদীতে ফেলে। মানুষ বলল যে, কত ডেডবটি তো কত দিকে যাচ্ছে, এই সময় ডেডবডি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমার মায়ের বাড়ি ওইখানে। তার ধারণা ছিল ডেডবডি পাওয়া গেলে হয়ত কবর টবর দিতে গেলে স্মৃতিচিহ্ন রাখা যাবে। সেইসময় আসলে কার স্মৃতি কে রাখে!
উজান ভাটিতে সে ভেসে চলে গেছে… ।
মার্চে যুদ্ধ শুরু হয়নি, মার্চে আসলে একতরফা আক্রমণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা অর্গানাইজ হতে হতে মে-জুন মাস পর্যন্ত লেগে গেছে। যেমন, আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম মিটিং হয় জুন মাসে। তারপরে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র দেয়া হবে কি হবে না, এসব নিয়ে ভারতের আর্মি, ভারত সরকারের মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিতে নিতে অক্টোবর। একচুয়ালি মুক্তিযুদ্ধ যেটাকে বলে নয়মাস, আসলে যুদ্ধ শুরু হয়েছে অক্টোবরের শেষের দিকে। নভেম্বরে পুরো যুদ্ধটা হয়েছে। ডিসেম্বরে তো যুদ্ধ শেষ ই হয়ে গেল।
ভিগোরাস যুদ্ধটা যখন শুরু হয়ে গেল। এটা আর একটু কন্টিনিউ করার দরকার ছিল। এই কথাগুলো হয়ত, অনেকের কথার সঙ্গে মিলবে না। কারণ আমার মনে হয় যুদ্ধের আগুনে পুড়ে পুড়ে সৈনিক তৈরি করা না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। যে অসম্পূর্ণতা এখন বাংলাদেশকে তাড়া করছে। অর্থাৎ বিগোরাস যুদ্ধ ২/৩ মাসই হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ছিল ১৬/১৭ বছর। স্কুলের ছেলেপেলেরা বা যে কৃষক লাঙ্গল চালাত সে মেশিনগানের হ্যান্ডেল ধরেছে। জনগণ তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছে।
শুধু পালন করে নাই, সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটা জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। তারপরেও আমি যেটা বলছিলাম আর একটু সময় পেলে অনেক কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোলে আসত। যদি অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যে দেশগুলো স্বাধীণ হয়েছে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘসময় ধরে চলেছে। চীন, এ্যাঙ্গেলা, ভিয়েতনাম, কিউবা কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ নয় মাস, সেই তুলনায় অনেক কম। ঐ কারণেই আমি বলছি যে, এটা আর একটু প্রলম্বিত হওয়া বিভিন্ন কারণে দরকার ছিল। আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার দরকার ছিল।
যুদ্ধ যখন শেষের দিকে, আমরা তখন ভাল করে যুদ্ধ শিখে গেছি। যুদ্ধ করতে করতে আসলে যুদ্ধ শেখা হয়েছে। ট্রেনিং ছিল মাত্র ২১ দিনের। শেষের দিকে, ভিগোরাস একটা স্টেজে ডিসকন্টিনিউ করল। ভারতের সেনাবাহিনী, পাকিস্তান যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। আকাশসীমা ক্রস করল। সুতরাং তখন সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তখন গেরিলা যুদ্ধের উত্তাপ কিছুটা কমেছে আমাদের এলাকায়। সেই সময়ের যে হিসাব আমরা পাই, প্রত্যেক দিন গড়ে ছয় হাজার থেকে বার হাজার মানুষ বাংলাদেশে মারা গেছে। ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত খুব সম্ভব ২৮৭ দিন, এই দিনগুলোতে লোকক্ষয় হয়েছে।
যুদ্ধের শেষে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গেলাম। অস্ত্র জমা দিলাম। কাগজ লিখে দিলেন। কথা ছিল যে, মিলিশিয়া ক্যাম্প তৈরি হবে। সেই ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে রাখা হবে। পাকিস্তানের আর্মি, প্রশ্নবোধক পুলিশ এদের জায়গাগুলো পূরণ করবে ফ্রিডম ফাইটাররা। আর যারা স্টুডেন্ট তারা চলে যাবে লেখাপড়ার জন্য। যারা থাকতে চায়, তারা স্বাধীন দেশের মিলিশিয়া বাহিনীতে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত পরে শুনলাম, তোমাদের পরে ডাকা হবে। সত্যি কথা বলতে কি আমি ছোটখাট দুই একটা অস্ত্র রেখেও দিয়েছি। কিছু বুলেট, কিছু গ্রেনেড রেখে দিয়েছি। কারণ আমরা তখন ভয় পাচ্ছিলাম এই যে হঠাৎ অস্ত্র রেখে দেয়ার পর আমরা কিভাবে বাঁচব?
হঠাৎ করে করার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল। ফলাফল তাই হয়েছে, আমার কাজিনকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। অনেক ফ্রিডম ফাইটার তখন মনের জোরটা হারিয়ে গেছে। এইসময়ে পত্রিকা থেকে নির্দেশ আসত তোমরা অস্ত্র জমা দাও কিন্তু তাদের সিকিউরিটি, জীবনের দায়িত্ব, এত প্রশিক্ষিত, উচ্চ মাত্রার দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে যুদ্ধ করে হঠাৎ এক সপ্তাহের নোটিশে তাদের বিদায় করে দেয়াটা আমার কাছে সুপরিকল্পিত বলে মনে হয়নি। পরিকল্পনা ছিল মিলিশিয়াতে নিবে, সেটাও নেয়নি। এই ডিসিশন চেঞ্জ করাটা সেই সময় সব মুক্তিযোদ্ধাকে আহত করেছিল।
বাড়িতে ফিরে আমরা আরও কিছু খবর পেলাম। কারণ, যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িতে কে মারা গেছে, কে যায় নি, এই খবরগুলো নিতাম না। কারণ আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি। ভারাক্রান্ত হলে পরে অসুবিধা আছে। ভারাক্রান্ত হলে পরে যুদ্ধ করা যায়না। হাত থেকে গ্রেনেড পড়ে ব্লাডেড হয়ে অনেক মারা যায়। সবার হয়না, সবার মানসিক কাঠামো হয়ত দৃঢ় না। যুদ্ধশেষে গ্রামে এসে দেখলাম আমাদের গ্রামের অনেক মানুষ মারা গেছে। আমার গ্রামের নুরু চাচা মারা গেছে। আমার ভগ্নিপতি মারা গেছে। আমার বড় ভাইয়ের মারা যাবার খবর তো যুদ্ধে থেকেই শুনেছি। আর যেটা শুনছিলাম যে, আমি মারা গেছি। মানুষের মুখের ধারণা যে আমি মারা গেছি। সুতরাং আসার পরে মানুষ অবাক হয় যে কিভাবে এলো! এবং আমাদের গ্রামের অনেক লোকই মারা গেল।
ফুফাত ভাই ফিরোজ ভাই, ভগ্নিপতি মোকশেদ আলী একই দিনে মারা যান। আমাদের গ্রামের ভাই, উনি সবার জামা কাপড় সেলাই করে দিতেন ইদন ভাই, উনি রাজাকার এবং আর্মিদের দেখে দৌড় দিয়েছিল। দৌড়ের মধ্যে উনাকে গুলি করেছে। গুলি খেয়ে আমাদের পুকুরে পড়ে। তার ডেডবডি কয়েকদিন পুকুরে ছিল। পরে কে কবর দিয়েছে আমি জানিনা। আর আমার একদম ফাস্ট কাজিন নাসির ভাই তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। সেই গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত আর ফিরেনি। তাকে কখন কিভাবে হত্যা করা হলো! আমার চাচী ভোররাতে উঠে কাঁদতেন। কান্নার সময়টা বোধহয় ভোররাতে খুব তীব্র হয়। আমার চাচী ভোররাতে উঠে কাঁদতেন।
আমরা যখন অস্ত্র জমা দিতে যাচ্ছি, তখন গ্রামের কৃষক লোকজন আমাদেরকে যুদ্ধের সময় খাওয়াত। তারাও কিন্তু ফ্রিডম ফাইটার। এরা না খাওয়াইলে আমরা মারা যেতাম। গেরিলা ওয়ার ফেয়ারের কোন সাপ্লাই কোড থাকেনা আর্মির মতো। তাদের কেউ খাদ্য সরবরাহ করে না। তাদের কোন ইনফরমেশনের জন্য তাদের কোন গোয়েন্দা বাহিনী নাই। সুতরাং পিয়রলি জনযুদ্ধ, এটা পিপলস ওয়ার। তো, দীর্ঘদিন ওরা আমাদের খাইয়েছে। একটা সেকশন আমার সঙ্গে থাকত। ২০ জন। ২০ জনের খাবার যোগাড় করা, ডিসেম্বরে কাঁথা যোগাড় করা, এখন তো আবহাওয়ার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে, তখন প্রচণ্ড শীত ছিল।
গ্রামের একটা বাড়িতে ২০ টা ছেলের জন্য কাঁথা যোগাড় করা অত সহজ না। মানুষেরা নিজে গায়ে না দিয়ে আমাদেরকে দিয়েছে। আমরা যখন অস্ত্র জমা দিতে যাই, তখন ওরা ক্ষেতে কাজ করছে। ওরা ক্ষেত থেকে দৌড়ে আসছে। বলেছে, আপনারা তো চলে যাবেন। দেশতো এখন স্বাধীন। বিদেশীরা তো নাই। এখন তো সব সম্পদ আমাদের। আর সব ক্ষমতা আপনাদের কাছে। সুতরাং আমাদের এখন ভুলে যাবেন না। আমার ছেলেটার চাকরি দরকার, আর আমরাতো যতদূর পারছি সাহায্য করছি। আমাদের খবর দিয়েন।
বাংলাদেশ এই মানুষগুলোর সঙ্গে বিট্রে করেছে। আমরাও বিট্রে করেছি। এই সাধারণ মানুষরা যারা আমাদেরকে খাওয়া পরার যোগান দিয়েছে, স্বাধীনতার পরে অঙ্গীকার করা হয়েছিল একটা সুনির্দিষ্ট সচ্ছলতার জীবন তাদেরকে দেয়া হবে। একারণেই কিন্তু মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তারপরবর্তি সময়ে এইসব মানুষ বয়ষ্ক কৃষক, আমরা খবর পেতাম, যারা আমাদের সাহায্য করেছিল তারা মারা যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি এমন দূর্ভাগ্যজনক ছিল তারা তখন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পুরোপুরি বাঁচার ব্যবস্থা করেনি। তারাই বরং নানান যায়গায় আক্রান্ত হয়েছিল। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, ১৬ ডিভিশন। সম্পদ লূণ্ঠনে জড়িয়ে পড়ছিল কেউ কেউ।
কেউ কেউ টাকার অভাবে, খাদ্যের ও অস্ত্রের অভাবে মারা যেত। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আস্তে আস্তে যে অঙ্গীকার করেছিল, যে মানুষের মুক্তি হবে, মানুষ খেয়ে পরে বাঁচবে তা থেকে সরে গেছে। বঙ্গবন্ধু এই কথাগুলো বারবার বলত। সুতরাং যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের যে বিজয়গুলো এগুলোর সঙ্গে আমার প্রায়ই একাত্ম হতে খুব কষ্ট হয়। এই যে, স্মৃতিচারণ করা, সফলতা বর্ণনা করা, হ্যা বড় অর্জন হয়েছে। আমরাও হয়ত দায়িত্ব পালন করেছি। এবং সমগ্র সাউথ ইস্ট এশিয়ায় বাংলাদেশের ছেলেরা, যে বয়সে মানুষ খেলে দাড়িয়াবান্ধা, ডাঙ্গুলি, হালচাষ করে সেই বয়সে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো একটা ভয়ঙ্কর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। সো উই হ্যাভ ডান আওয়ার রেসপন্সিবিলিটি। তারপরে যারা রাষ্ট্র শাসন করেছে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি কিনা আমি মন্তব্য করব না। এই প্রশ্ন আমার থাকবে। করে থাকলে মানুষ এত কষ্ট পেত না।
করে থাকলে মানুষ এত দূর্ভাগ্যজনক অবস্থায় পড়ত না। এর আগে অনেক দেশ স্বাধীন হয়ে অনেক উন্নত পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা একটার পর একটা শাসক পাচ্ছি যারা অর্থ উপার্জনের জন্য অভীষ্ঠ থেকেছে । ফলে মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা বাস্তবে রূপ পায়নি। কিছুটা ভিন্ন ধরণের শক্তি জাতীয়তাবাদী দল, কিম্বা নানান ধরণের রাজাকার টাজাকার ছিল, যারা একসময় মুখ খুলতে পারত না, তারা আস্তে আস্তে মুখ খোলার চেষ্টা করল। তারা পলিটিক্যাল শেল্টার পেল। তারা উঠতে উঠতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে বাংলাদেশ নিয়ে আশঙ্কা করি। কারণ, তাদের নানান পলিটিক্যাল কানেকশন আছে। অন্যদিকে, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা, যথেষ্ট সংগঠিত তাদেরকে শক্তিশালী যায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়নি । প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখনও সম্মান পায়না।
আমরা এখনও গ্রামে গিয়ে দেখছি, সামনে এক ঝাঁক অপুষ্ট, ভারাক্রান্ত বিষন্ন কতগুলো মানুষ বসে আছে। এই মুক্তিযোদ্ধাদের দূর্বল করা, তাদের পরিচয় সংকট তৈরি করা, কিস্তিতে কিস্তিতে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করা, এগুলো আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা না, একটা রাষ্ট্র দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বিজয় অবশ্যই সেলিব্রেট করি। বিজয় অবশ্যই মহান। বিজয়ের জন্য, যে যুদ্ধ হয়েছে সেটা মহোত্তর। তবে, বিজয়ের যেসব আনুষ্ঠানিকতা এবং উৎসব হচ্ছে স্বাধীনতার পরে বরং মূল জখম এই যায়গায় যে, বাংলাদেশ কেন শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে পারল না। সাধারণ মানুষ কেন মুক্তিযোদ্ধাকে মন থেকে গ্রহণ না করে অন্য রাজনীতির দিকে কেন ঝুঁকে যায়, এজন্য শাসকদের উচিত তাদের রাষ্ট্র শাসনের কোন দূর্বলতা আছে কিনা, কোন ব্যর্থতা আছে কিনা এগুলোকে সংশোধন করা, না করলে বিজয় দিবসের দিন শুধু আকাশে জঙ্গী বিমান উড়বে। কুচকাওয়াজ হবে এবং সেটা হবে ফর্মালিটি । আমরা ফর্মালিটির জন্য যুদ্ধ করিনি। আমরা আমাদের কাছের লোক হারিয়েছি। আমি আমার ভাই হারিয়েছি। আমি যোদ্ধাদের অর্ধেক হারিয়েছি। স্বাধীনতার যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ মরেছে। যুদ্ধের পরে কেউ কেউ মরেছে অপুষ্টিতে। তারা যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা ছিল তারা এডজাস্ট করতে পারত না। তারা মুখের উপর সত্যি কথা বলে দিত। ফলে, একটা কনফ্লিক্ট হতো, এই কনফ্লিক্টে প্রায় তারা আক্রান্ত হয়েছে। নিরাপত্তা নষ্ট হয়েছে। তারা মারা গেছে। আজকের দিনে স্বাধীনতা, বিজয় দিবস নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া আমি যা বলেছি, তা আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করে। আনন্দ, সফলতা, সীমাবদ্ধতা, মানুষকে মুক্তির স্বাদ দিতে না পারা। যে ধরণের রাষ্ট্রের জন্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে বারবার এই কথা বলেছেন, আমি কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এরা আমার সাধনাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই দুর্নীতিবাজরা সবাই শিক্ষিত এবং প্যান্ট পরা ভদ্রলোক। এরা বাংলাদেশের…।
তিনি আর একটা কথা বলেন, আমরা আইয়ূব-ইয়াহিয়ার সঙ্গে যদি যুদ্ধ করে পারি, তাহলে এইসব দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে কেন পারব না। এই কথা বলার পরে আর তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। পরে, যারা ক্ষমতায় এসেছিল তাদের দায় ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শে থাকা। তারা স্টেট সোশ্যালিজম থেকে সরে গেল। ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে তাজউদ্দিন আহমেদ ধমকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে বরণ করে নিই। আমি যেহেতু সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকতা করি আমার পক্ষে এগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সুতরাং এইসব সিচুয়েশন স্বাধীনতা, বিজয় দিবসের আনন্দকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়।
এখন প্রত্যেক দিন আমার কোন না কোন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু মারা যাচ্ছে । বিজয় দিবসের দিন আনুষ্ঠানিকতার চাইতে বাংলাদেশের মূল অঙ্গীকার হওয়া দরকার রাষ্ট্র এবং মানুষকে শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন রক্ষা করা। যে লুণ্ঠন থেকে বের হওয়ার জন্য এত মানুষ মারা গেল সেই লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
# মুক্তিযোদ্ধা, সহ সভাপতি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
# সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লাল সবুজের কথা ডটকম।
আরও পড়ুন : রক্ত স্রোতে পবিত্র হয়ে জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতির স্বাধীন বাসভূমি বাংলাদেশ : ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ
আরও পড়ুন : আমাদের মতো মানুষের কাছে একাত্তরের স্মৃতি বিবিধ : আফসান চৌধুরী
আরও পড়ুন : একদিকে বিজয়ের উল্লাস, অন্যদিকে প্রিয় দুই শিক্ষকের মৃত্যু আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল : ডা. মাগদুমা নার্গিস রত্না
আরও পড়ুন : রেডিওতে পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর শুনে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই : সাইফুল ইসলাম
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা