অনলাইন ডেস্ক
টানা কয়েকদিনের অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রাম জেলার সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুকুমার নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেছে।
ফলে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুকুমার নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চরম কষ্টে দিনযাপন করছেন বানভাসী মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে পানি ওঠায় বন্ধ হয়েছে পাঠদান কার্যক্রম।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। কারণ সেসব এলাকায় বন্যার তীব্রতা বাড়ছে, নদীগুলোর পানি আরও বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
জেলার অনেক চরাঞ্চলের বসতভিটা ৩ দিন আগে পানিতে ডুবে গেছে। রান্না করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় শিশু ও গবাদিপশু নিয়ে অনাহারে অধ্যাহারে দিনাতিপাত করছে চরাঞ্চলের বাসীন্দারা।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চর গ্রামের মমেনা বেগম (৪০) বলেন, ঘরে পানি উঠেছে ৩ দিন হলো, ছোট শিশুকে নিয়ে রান্না করতে পারি না।ঘরে শুকনা খাবার নাই। এখন পর্যন্ত কেউ দেখতেও আসলো না। কেউ কোন প্রকার সাহায্য সহোযোগিতাও করছে না। এখন নৌকাতে মালামাল নিচ্ছি পশ্চিম পাড়ায় আত্মীয় বাড়ি সেখানে যাবো।
একই এলাকার আরমান আলী নামের একজন বলেন, বৃষ্টির কারণে আজ ৮-৯ দিন কোন কাজ কর্ম নাই বসে আছি। হাতে জমানো টাকা নাই। এতো পরিমাণ কষ্টে আছি ভাই আপনাদের কে বলার মত কোন ভাষা নাই। হাতে টাকা থাকলে দোকান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যেতো।
এদিকে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুকুমারের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে সদর, উলিপুর,নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, চিলমারী, রাজিবপুর রৌমারী ও রাজারহাট উপজেলার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর, রলাকাটা, খেয়ার আলগা, বড়ুয়া, ঝুনকারচর, অষ্টআশির চর, চর ঘনশ্যামপুর ও মাঝিয়ালির চরের প্রায় ৫ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।
স্থগিত পাঠদান কার্যক্রম:
বন্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ঝুঁকি থাকায় বন্যাকবলিত স্থানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে পাঠদান কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শাহীদুল ইসলাম জানান, রৌমারী এবং কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা মিলে মোট ৫৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় সংখ্যা বাড়তে পারেও বলে জানান তিনি।
অপরদিকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম জানান, এখন পর্যন্ত কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধের খবর পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতের ভোগান্তির খবর পাওয়া গেছে। বন্যার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যাও কমে গেছে বলে জানান তিনি।
উপজেলা গুলোতে বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন:
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ উপজেলাগুলোতে ত্রাণ, নগদ অর্থ এবং চাল বরাদ্দ দিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান, ইতোমধ্যেই আট হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো হয়েছে। রৌমারীতে ২০০ প্যাকেট ত্রাণ, আড়াই লক্ষ টাকা, ১০ মে.টন চল; রাজিবপুর উপজেলায় ২০০ প্যাকেট ত্রাণ, এক লক্ষ টাকা, ১০ মে.টন চল; রাজারহাট উপজেলায় লক্ষ টাকা, ১০ মে.টন চল সহ প্রায় সকল ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে আজকে ত্রাণ বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
কুড়িগ্রাম-রমনা রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ:
ভারী বর্ষণে কুড়িগ্রাম-রমনা (চিলমারী) রেলপথের কাছাকাছি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় ওই রেলপথে রমনা কমিউটার ট্রেন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার (১৭ জুন) থেকে ওই রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কুড়িগ্রাম রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার সামসুজ্জোহা।
স্টেশন মাস্টার জানান, অতিবৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রাম-রমনা রেলপথের কয়েকটি স্থানে রেলপথের পাশে পানি জমে থাকায় ওই রেলপথটি ট্রেন চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ওই রেলপথটি ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় কর্তৃপক্ষ আপাতত কুড়িগ্রাম-চিলমারী রুটে রমনা কমিউটার ট্রেন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ওই রেলপথে ট্রেন চলেছে। তবে ট্রেনটি পূর্ব নির্ধারিত সিডিউল অনুযায়ী কুড়িগ্রাম রেল স্টেশন থেকে রংপুর ও লালমনিরহাট রুটে চলাচল করবে।
নদী অঞ্চল ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত আশেপাশের এলাকা:
টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদ-নদীর পানি ছাড়াও সমতল স্থনের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিজমিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। তলিয়ে গেছে পুকুর সহ রাস্তাঘাট। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎসচাষীরা। উলিপুর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের মৎসচাষী ভীম রায় বলেন, প্রায় ২ লাখ টাকার মাছ পুকুরে ছেড়েছিলাম এবার। বৃষ্টিতে পুকুর তলিয়ে গিয়ে প্রায় সব মাছ বের হয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় প্রায় সবার পুকুর তলিয়ে গেছে।
অবনতির পথে বন্যা পরিস্থিতি:
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে আগামী ২৪ ঘন্টায় নদ-নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বর্তমানে ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার, দুধকুমারের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপদসীমার সামান্য নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।