দেশের নানা অঘটনের মধ্যে আমাদের সবার চোখের সামনে সাত কলেজ আন্দোলনে আরও একজন ছাত্রের চোখের কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার খবর জানা গেছে। এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত দুজন ছাত্রের চোখের ক্ষতি হলো। এ ছাড়া এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যৌন নিগ্রহ, উপাচার্য আক্রান্ত, প্রক্টর ঘেরাও, মিছিল, বিক্ষোভ, ফটকে তালা, ছাত্রলীগের হামলার মতো ঘটনা ঘটেছিল এবং ঘটছে। এর কোনোটিই গুজব নয়, বাস্তবতা। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পরে সংশ্লিষ্টদের তরফে যে দিকটি প্রায় একেবারেই অনালোচিত থেকেছে, সেটি হলো আইনগত দিক। সে কথায় পরে আসছি।
শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর কুযুক্তি দিয়ে সাত কলেজের অধিভুক্তি ঘটেছিল। তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একবারের জন্যও ইঙ্গিত দেননি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বা প্রশাসন দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত কি না। ১৯৯২ সালের আগে এই ব্যবস্থা ছিল, তাই সিকি শতাব্দীর ব্যবধানে কী পরিবর্তন ঘটেছে, তা একদম বিবেচনায় না নিয়ে এভাবে যে সাত কলেজকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হলো, সেটা তুঘলকি কাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ তৎকালীন উপাচার্য এ-বিষয়ক সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন। পত্রিকায় অবশ্য ধুমসে বিষয়টিকে দুই ভিসির রেষারেষি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আরেফিন ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ) হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে একটি রাজনৈতিক হিসাব হয়তো কাজ করতে পারে। বিষয়টি অনেকটা রাজধানী ঢাকাকে দুই টুকরা করার মতো একটা জেরিমেন্ডারিং (সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্বাচনী এলাকার আয়তনে পরিবর্তন আনা) হতে পারে।
প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল, ক্যাম্পাসে নতুন করে বিক্ষোভ চলছে। সর্বশেষ ছাত্রলীগের তালা খোলার ঘটনায় বিচলিত বোধ করার বিষয় আছে। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলো যদি স্বকীয়তা হারিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতোই আচরণ করে, তাহলে তার কী বিপদ হতে পারে, সেটা যাঁদের বোঝার কথা, তাঁরা এখনো বুঝছেন বলে মনে হয় না।
সাত কলেজবিরোধী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের যৌক্তিকতা বা জনপ্রিয়তাকে নাকচ করা যাবে না। সুতরাং এই আন্দোলনে যারা তালা ঝোলায়, ক্লাস কিংবা পরীক্ষা বর্জন করে, তাদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তালা খুললে তারাই খুলে দিত। সেই কাজটি ছাত্রলীগকে কেন করতে হলো? ছাত্রলীগ যা করল, যা বলল বা যেভাবে শাসাল, সেটা প্রকারান্তরে ‘আইন হাতে তুলে নেওয়া’ চলমান সংকটকে স্মরণ করিয়ে দিল। এর আগে শুনেছিলাম, এস এম হলে ক্যালকুলেটর ফেরত চাওয়ায় তিনজনে মেরে একজনের কর্নিয়া নষ্ট করেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ‘গণপিটুনি’র পর্যায়ে পড়ে কি না?
তবে সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির বিষয়টিকে আমরা শিক্ষানীতি ও আইনের আলোকে দেখতে চাই। ঘোরতর শিক্ষকসংকটে ধুঁকতে থাকা ২ হাজার ২৬০টি কলেজের প্রায় ২১ লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেশনজটমুক্ত হয়ে থাকতে পারলে এই সাত কলেজ কেন দেড় বছর পেরোনো সেশনজটে ঘাম ঝরাবে। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বরাতে প্রথম আলোর প্রতিবেদনটির সূচনাতেই বলা হয়েছিল, সারা দেশের কলেজগুলোকে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাত কলেজ এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এই মনোভাব শিক্ষানীতিবিরুদ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সূতিকাগার। সাত কলেজের দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারার শিক্ষার্থীদের স্রোতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে এই বিদ্যাপীঠের মূল ঐতিহ্যগত চেহারাটা বদলে দেওয়া সম্ভব হবে। সম্ভবত এমন বিবেচনা থেকেই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল। এটা এই কলাম লেখকের ধারণামাত্র। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি নিজেই বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে সাত কলেজকে করতলগত করেনি। এটি ছিল একটি ‘জাতীয় সিদ্ধান্ত’। আবার একে অবৈজ্ঞানিকও বলেছেন। তার মানে, জাতীয় সিদ্ধান্তও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে নেওয়া হতে পারে। ২১ জুলাই ঢাবির সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেছিলেন, ‘সাত কলেজের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের এখতিয়ার আমাদের নেই।’ এর ৭২ ঘণ্টা পরে তাঁকেই আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়েছে। এটি লোকদেখানো। কারণ, এই কমিটির কোনো নির্দিষ্ট কার্যপরিধি নেই। ১১ সদস্যের এই কমিটির এক সদস্য প্রশ্নের উত্তরে বললেন, যা সবার জন্য মঙ্গল, তা-ই সুপারিশ করা হবে। ১০ কার্যদিবসে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। কিন্তু জানা গেল ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ভিসি প্যানেল দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই তা নিয়ে ব্যস্ত। বৈঠকে বসতেই অনীহা।
তবে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের ওই বক্তব্য বিদ্যমান আইন ও শিক্ষানীতির আলোকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪ (খ) ধারা বলেছে, যেকোনো ‘কলেজের অধিভুক্তি এবং অধিভুক্তি বাতিলের ক্ষমতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকবে।’ আইনে দুই ধরনের কলেজ আছে ‘অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ ও কন্সটিটুয়েন্ট কলেজ’। দুটো সম্পর্কেই পরিষ্কার বলা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সংজ্ঞায়িত করবে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা ঐতিহ্যগতভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সব সময় স্পর্শকাতর থেকেছেন। শিক্ষকেরা দীর্ঘ সময় ধরে নীল-সাদায় বিভক্ত থাকলেও তাঁরা সব সময় স্বায়ত্তশাসন খর্ব না হওয়ার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রবণতা দেখিয়েছেন। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা নীরব বা কম সরব। ছাত্রনেতারা ধুম সরব। ডাকসুর এজিএস ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনে করেন, এটা ছিল একটা আনহ্যাপি ম্যারেজ। তিনি ‘পিসফুল ডিভোর্স’ আশা করছেন। এজিএস কী চাইছেন, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে শুনলাম, ছাত্রলীগদলীয় ডাকসুর জিএসের বক্তব্য ঠিক এ রকম নয়।
ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশনই ভেবেছিল, ভবিষ্যতে এই কলেজগুলো কীভাবে চলবে। তারই সুপারিশের আলোকে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে নির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া হলো। সেই হিসাবে এই সাত কলেজসহ ঢাকায় যত কলেজ আছে, তার দেখভালের জন্য ঢাকায় প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি ‘বিভাগীয় কেন্দ্র’ এবং পরে তাকে অ্যাফেলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার কথা ছিল। একইভাবে প্রতিটি বিভাগে একটি করে অ্যাফেলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় হবে। শিক্ষানীতির ৬৭ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, কেন্দ্রগুলোকে বিধিবদ্ধভাবে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিতে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ’ নেবে।
সুতরাং, সাত কলেজ নিয়ে দুই ভিসির রেষারেষির প্রশ্ন টেনে আনার খুব যুক্তি নেই।
সহ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ তাঁর প্রতিবেদনে এসবের নিরিখে সুপারিশ রাখবেন বলে আমরা আশাবাদী। গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় একজন সিনেটর হিসেবে তিনি যথার্থই ১৯৯২ সালের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে সাত কলেজ স্থানান্তরের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমরা মনে করি, তাঁর সেই অবস্থান যথার্থ। তবে কমিটির প্রতিবেদনে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসেনি, আবার কমিটির প্রতিবেদনেও সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটবে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত লাগবে।
NB:This post is copied from www.prothomalo.com
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা