আবু হাসান টিপু : এনআরসি’র বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র ভারতবাসীর প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণে দেশটির ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী মোদি সরকার সাম্প্রতিককালে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশকারী অমুসলিমদের নাগরিক হওয়ার অনুমতি দেয়। এতে করে এসব দেশ থেকে যে সকল মুসলমানরা ইতোমধ্যে ভারতে বসবাস করছেন তাদের নাগরিক হওয়ার অধিকার পুরোপুরি অস্বিকার করা হয়। যদিও মোদির সমর্থকরা এই সিএএ-এর পক্ষ অবলম্বন করে বলছেন, এর ফলে ভারত ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের অভয়াশ্রমে পরিণত হবে। অপর দিকে আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই বিলটি মুসলমানদের একঘরে করতে বিজেপি এজেন্ডার একটি অংশ। অনেকেই বলছেন ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান দেখা যায়। এমনকি ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুনর্নির্বাচিত হলে এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তবে এনআরসি আর সিএএ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কি নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেরই অংশ? এ প্রশ্নটি আজ ভারতবাসীসহ সারা বিশে^র মানুষের কাছেই জাজ¦ল্যমান হয়ে উঠেছে।
গত বছর এই সিএএ পাস হওয়ার পরে থেকেই সমগ্র ভারত জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এর মধ্যে কয়েকটি বিক্ষোভ সহিংস আকারও ধারণ করে। তবে দিল্লিতে এখন পর্যন্ত হওয়া সব বিক্ষোভই ছিল শান্তিপূর্ণ। মূলতঃ বিতর্কিত এই নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে রোববার থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে গত কয়েকদিন ধরে, দিল্লি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সহিংসতা প্রত্যক্ষ করছে। ভারতের রাজধানীতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
বর্তমানে এই সহিংসতা কেবল নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে হচ্ছে না, এটি এখন সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছে এবং আশেপাশের কয়েকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আক্রমণ করা হচ্ছে। একদল লোক হাতে লাঠি-সোটা, লোহার রড এবং পাথর নিয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে। এসব এলাকার প্রধান সড়কগুলোর অবস্থা এখন বেশ থমথমে। রাস্তাগুলোয় পাথর এবং ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভাঙ্গা ও পোড়া যানবাহনগুলো এবড়োথেবড়ো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে এবং আগুন জ্বলতে থাকা শতশত ভবন থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার কুন্ডলি বাতাসকে ভারি করে তুলেছে। সহিংস দাঙ্গাকারীরা মুসলমানদের বাড়িঘর ও দোকানপাট লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, ভাংচুর করছে, করছে লুটপাট, অগ্নি সংযোগ। মসজিদে মসজিদে হামলা ভাংচুর এমন কি অগ্নি সংযোগ পর্যন্ত করা হচ্ছে।
রাজধানীর কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব দিল্লির তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে রোববার থেকে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছিল তাদের অবরোধের বিরুদ্ধে এক কিলোমিটার ব্যবধানে পাল্টা বিক্ষোভ করে এই আইনের সমর্থকরা। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। এরসঙ্গে বিজেপির এক হিন্দুত্ববাদী নেতা কপিল মিশ্র যুক্ত বলে জানা গেছে, যিনি নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারীদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প ভারত ছাড়ার পরেই তাদের (মুসলমানদের) জোর করে উচ্ছেদ করা হবে।
এসব হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ যার অধিকাংশই মুসলমান। গুলিবিদ্ধ ও বিভিন্ন ধরণের ক্ষতসহ আহত ব্যক্তিদের ভিড় যেন কমছেই না হাসপাতালে। স্থানীয় প্রধান হাসপাতালটিতে একধরণের ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। আহতদের মধ্যে অনেকে প্রাণ ভয়ে বাড়ি ফিরে যেতেও খুব ভয় পাচ্ছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দাঙ্গায় অংশ নেয়া বেশ কয়েকজনকে হাতে বন্দুক বহন করতে দেখা যাচ্ছে। শহরের আশপাশের হিন্দু বাড়ী ঘরের ছাদ থেকে গুলি করা হচ্ছে। হাসপাতালের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন যে আহতদের অনেকের শরীরেই গুলির ক্ষত রয়েছে। এদিকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালের চিকিৎসকরা আরও নতুন এক তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আহত অনেকের চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে। অন্ধ হয়ে গেছেন অনেকেই। কারো পুরো মুখমন্ডল ঝলসে গেছে। ভারতের একটি দৈনিকের অনলাইন জানাচ্ছে, মুস্তাফাবাদ থেকে বেশ কিছু আহত এসেছেন হাসপাতালে। তাদের অনেকের চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে। ইতোমধ্যে দৃষ্টি হারিয়েছেন চার জন মুসলমান। খুরশিদ নামে এক জনের দুচোখই নষ্ট হয়ে গেছে। তেগ বাহাদুর হাসপাতাল থেকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সও পাননি তিনি। গিয়েছেন রিকশায়। দুই চোখ-সহ পুরো মুখই ঝলসে গিয়েছে ঐ ব্যাক্তির।
উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সাথে দিল্লির যে সীমান্তের ভাগ রয়েছে – এই অঞ্চলগুলো তার কাছাকাছি এবং এই সীমান্ত এখন আটকে দেওয়া হয়েছে মোদি সরকারের নির্দেশে। এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি এবং বেশ কয়েকটি এলাকায় জনসমাগমের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলে নিজ দেশে পরবাসী হওয়া এই মুসলমানরা যেন মৃত্যু উপত্যকায় এক বিভীষিকাময় জীবন কালাতিপাত করছেন।
দুর্বলের উপর সবলের আক্রমন, সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর আক্রমন আর বিশ^ জুড়েই উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির আস্ফলন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কালেকালে যুগেযুগে কেবল নিরিহ সাধারণ মানুষের জান আর মালেরই ক্ষতি করেছে। পৃথিবীর কোন দেশের কোন ইতিহাসে উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি। ভারতের উগ্র ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বিরোধী আন্দোলনকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দিকে ঠেলে দিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা একটি কলঙ্কের তিলক হিসাবেই জ¦লজ¦ল করবে। এবং ভবিষ্যত পৃথিবীর অসাম্প্রদায়িক মানুষের গণআদালতে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপরাধে নিশ্চয় ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠিকে বিচারের কাঠগড়াতে দাঁড়াতে হবে।
# রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা