পর্ব-৩
আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
যাওয়ার পরে ওরা আমাদের ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিল। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খেয়ে, তারপরে গাজীপুর থেকে এক দালাল আর কি ব্রোকার যারা নৌকায় করে শরনার্থী পার করত। তারা বসে আছে। তারা বলল, হ্যা আমরা তো পার করি। তখন ওরা আমাদেরকে পিছু লাগিয়ে দিল। যে তোমরা হেঁটে হেঁটে চলে এসো। সারারাত ধরে হাঁটলাম। তখন তো ছিল ক্রোশ। এই বলে তিন ক্রোশ, দুই ক্রোশ। এইরকম বলে। সারারাত হাঁটার পরে, শেষ রাতের দিকে কাজীপুরে পৌঁছলাম। আমাদের হাত পা এইরকম হয়ে ফুলে গেছে। ঐ বাড়িতে তারা খাবার খেতে দিল। আমরা চাল ডাল কিনে দিলাম। রান্না করে দিল। এইরকম দুই তিনদিন যায়। আর নৌকা আর পাঠায় না। তখন আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা কি ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম। কাজীপুরের লোক তো সিরিয়াস। এরা আমাদেরকে পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। আমাদের মেরেও ফেলতে পারে। টাকা পয়সা কেড়ে নিতে পারে। তখন আমরা রাস্তায় যেতে আর একজন আমাদের সাথী হয়েছিল। তখন আমরা পাঁচজনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাব। কিভাবে যাওয়া যায়? আমরা দিনের বেলায় অনুসন্ধান লাগালাম এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ আছে। যাকে বলে ওয়াবদা বাঁধ।
ঐ বাঁধের ঐ পাশ থেকে কোষা নৌকা আসে, মাইনক্যার চরে যায়। আমরা গভীর রাতে দুই ভাই বের হলাম। খোঁজ নেয়ার জন্য নদীর পারে চলে গেলাম। তখন আড়াইশ টাকা দিয়ে আমরা ভাড়া মিটালাম। মিটিয়ে গভীর রাত্রে তখন ঐ বাড়ির মধ্যে যে বিছানা দিয়েছে, বিছানার কাঁথা দিয়েছে। খড়ের গাঁদার উপর দিয়ে মানুষের মতো বানিয়ে ঢেকে রেখে তারা যেন বুঝে মানুষের মতো শুয়ে আছে, বানিয়ে রেখে আমরা পালালাম। রাতভর নৌকাতে ঘুরে এক চর দিয়ে কাজীপুরের ক্যাম্পের কাছে যাবার পর বলল যে, এখান দিয়ে যেতে পারবে কিন্তু মানুষকে তো সার্চ করবে। আপনারা পায়ে হেঁটে অমুক যায়গাতে থাকেন, আমরা তুলে নিব। আমরা পায়ে হেঁটে গেলাম। চিন্তা করলাম, চাল ডাল দরকার। চরে গিয়ে দেখলাম, চরের লোকজন খুব গরীব। খুব ক্ষুধার্ত। তারা নিজেরা খায়নি। একজনের বাড়িতে গিয়ে বললাম খেতে টেতে দেন। বলে, আমাদেরই খাবার নাই। তোমাদের কি দিব। তখন বললাম যে পান্তা ভাত যদি থাকে তো তাই দেন। আমাদের দেশে হতো কি চীনা ধান, চীনা আর আউশ আমনের চাল মিশিয়ে ভাত রান্নার পান্না দিয়েছে। সেই পান্তা খেলাম আমরা। সেই সাথে দুই তিনটা করে পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়েছিল। পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ তো, আমরা একটা করে পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ খেয়ে বাকিগুলো পকেটে নিলাম যে রাস্তায় যদি রান্না করে খাওয়া লাগে তো এগুলো কাজে লাগবে। তারপরে ঐ বাড়িতে খাইতে যাই, আর মানুষের বাড়িতে গিয়ে চালডাল চাই। হাতে তো তেমন টাকা পয়সা নাই। সংগ্রহ করছি। আর মানুষের কাছে চাল ডাল চাচ্ছি। এভাবে বুঝতে পারছিলাম যে, চার-পাঁচদিন লাগতে পারে।
তো, তখন তো হাটবাজার তেমন একটা ছিলনা। তারপরে গেলাম। নৌকায় উঠলাম চালডাল নিয়ে। নৌকা প্রায় পাঁচদিন পরে আমরা গিয়ে পড়লাম ফুলছড়ি বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছে। তখন নৌকার মাঝিরা বলল যে আজকে রাত্রে আর পাড়ি দেয়া যাবে না নদী। কারণ মাঝখানে ফুলছড়ি বাহাদুরাঘাট থেকে স্টিমার আর গানবোট সেনাবাহিনীর লোকরা টহল দেয়। তো এই টহলের মাঝে যতটুকু সময় পাওয়া যাবে তখনই আমরা এর মাঝ দিয়ে বের হয়ে যাব। তো ভােরবেলা আমাদের পাশে অনেক শরনার্থী নৌকায় বসে ছিল। ১০-১৫ টা। এটা আমরা তখন মজা করতাম খুব। পাঁচ ছয়দিন নৌকার মধ্যে থাকছি । আর শরনার্থী নৌকার মধ্যে এত লোক আছে বোঝা যায়না। তখন আমরা মজা করে বলতাম, সকাল বেলা যখন প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য বালুর মধ্যে গেছি তখন বলতাম এখানে মলের যত ঢিপি তা দেখে অনুমান করা গেছে যে কত লোক থাকতে পারে। যদিও খুব সাইন্টিফিক ভিত্তি। তো আমরা বললাম, যে গোন এখন এখানে কত লোক আছে। অথচ বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। সকাল বেলা আমরা রান্না করে ডাল ভাত খেয়ে নৌকা পাড়ি দিচ্ছি। খুব বাতাস হচ্ছে। পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় শব্দ পেলাম। একটা নৌকা ধরে ফেলল ওরা। সামনাসামনি গুলি করে পানিতে ফেলে দিচ্ছে। ঐ ভয়ে আমাদের সাথে দুজন ছিল, তারা বলল ভাই আমাদের বাড়িতে যেতে দেন আমরা আর যাব না। আমি বললাম না আমরা আর এক পাও পিছাব না। যাবই। তারপরে দুপুর বারটার দিকে যখন একটু ফাঁকা হলো চট করে পাড়ি দিয়ে যেই কাছাকাছি গেছি এরমধ্যে স্টিমার আসছে। আমরা দৌড়ে কাশবনের মধ্যে ঢুকে গেছি। এরপরে রাত্রের বেলা আমরা ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ি দিয়েছি। আটচল্লিশ বছর পরে আমি আবার সেই জায়গায় গিয়ে ঘুরে এসেছি।
যমুনা পাড়ি দিয়ে পরে ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ি দিচ্ছি। ব্রক্ষ্মপুত্র যখন পাড়ি দিই প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। ওরা ফুলছড়ির ঘাট থেকে সার্চ লাইট দিয়ে দেখছে কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে না। আমরা এর মধ্য দিয়ে চলে গেলাম। মাঝি বলল যে, আর ভয়ের কারণ নেই এখন আমরা মুক্ত এলাকায় ঢুকে গেছি। প্রায় সাত দিন পরে আমরা মাইক্যার চর পৌঁছালাম। মাইক্যার চর পৌঁছার পরে সেখান থেকে চলে গেলাম রংপুরের রৌমারি ইয়ুথ ক্যাম্পে একটা যুব শিবির ছিল।
সেখানে গিয়ে আমরা উঠলাম। সেটা ছিল একটা মুক্ত এলাকা। একটা রিক্রুটিং ক্যাম্প ছিল। প্রায় সপ্তাহখানেক থাকার পরে আমাদেরকে ফায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলো ভারতের শিলিগুঁড়ি পানিঘাটা পাহাড়ে। সেইখানে আমরা একমাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। ২৮-৩০ দিনের মতো। সেখানে অস্ত্র চালানোসহ মর্টার, এক্সপ্লোসিভ, এলএমজি, এসএমজি, গ্রেনেড থ্রো, সবমিলিয়ে মোটামুটি সব ট্রেনিং অবস্টাকল এরিয়া পার করার জন্য প্রশিক্ষণ, কিভাবে সাহসী ভুমিকা নেয়া যায়, পেট্রোলিং করাল আমাদেরকে দিয়ে। সবকিছু করার পরে আমাদের অপারেশন ক্যাম্পে পাঠাল। অপারেশন ক্যাম্পে অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আবার আমরা দেশের দিকে মানে আমাদেরকে রুট দেখিয়ে দিল এখান দিয়ে এখান দিয়ে ঢুকতে পারবে। আমরা দেশের মধ্যে ঢুকতে লাগলাম। যেই রাস্তা দিয়ে ভারতে ঢুকেছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে আবার ফেরত আসতেছি। তো আমাদের রুট তো তখন মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। এর মাঝে ফুলছড়ির ঘাটে প্রথম আমরা হামলার শিকার হই, পাক বাহিনীর। এবং চরের মধ্যে আমরা প্রথম আমরা কাদার মধ্যে জড়ায়ে পাকবাহিনীর সাথে সারাদিন যুদ্ধ করার পরে রাত্রে বেলা পিছু হটে ওরা ওদের ক্যাম্পে চলে যায়।
আমরা সেই কর্দমাক্ত গ্রামে থাকলাম। আমাদের প্রায় তিন চারটা ট্যাংক হারালাম। এক্সপ্লোসিভ কিছু নষ্ট হলো। আমরা নিতে পারছিলামনা। নৌকায় থেকে গেল। পরে গভীর রাত হয়ে গেল। আমরা গ্রামবাসীর সহায়তা নিয়ে ক্যানেল দিয়ে আবার সেই ব্রক্ষ্মপুত্রর পাশ দিয়ে এসে যমুনার মধ্য দিয়ে পার হয়ে সিরাজগঞ্জের মধ্যে ঢুকে আমরা সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার মাঝামাঝি একটা নিরাপদ এলাকায় অস্ত্রসহ আস্তানা গাড়লাম। সেখান থেকেই মূলত আমরা গেরিলা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।
১৩ ই ডিসেম্বরে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। এমনিতে এর আগে যুদ্ধ আছেই। স্মরণীয় ঘটনা এই কারণে ঐ দিন আমি বাঘাবাড়ি নামক নৌবন্দরে গেছি যে, পাক বাহিনীরা আছে। ভারতীয় প্লেন এসে উড়ছে আকাশ দিয়ে। তখন সন্দেহ হলো যে আজকে বগুড়া ফল করেছে। মিলিটারিরা সব খতম। তখন আমরা বাঘাবাড়ি আক্রমণ করার জন্য আমি আমার দুইজন সহযোগী নিয়ে চলে গেছি। ঐখানে বাঘাবাড়ির কাছে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল। আমার খালার বাড়ি। ঐখানে থেকে প্রথমে খেয়েছি, সব খবর নিয়েছি। এরপরেই আমরা মিলিটারিরা যখন পার হলো তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছি। তারপর নদী পার হয়ে ঐপারে গেছি সন্ধ্যার দিকে। প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ পেয়েছি।
# আবুল বাশার, ভাইস প্রেসিডেন্ট, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।
# সিনিয়র স্টাফ রিপাের্টার।
চতুর্থ পর্ব বুধবার প্রকাশিত হবে।
আরও পড়ুন : পর্ব -২ আমি স্বাধীন দেশ ও পতাকা দিতে পেরেছি কিন্তু গণমানুষের মুক্তি আসেনি : আবুল বাশার
আরও পড়ুন : পর্ব – ১ : আমি স্বাধীন দেশ ও পতাকা দিতে পেরেছি কিন্তু গণমানুষের মুক্তি আসেনি : আবুল বাশার
আরও পড়ুন : আসলে একাত্তর সালের সময়টা মুখের কথায় বর্ণনা করা অত্যন্ত কঠিন : কামাল আহমেদ
আরও পড়ুন : রাজাকার যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তখন খুব খারাপ লাগে : আব্দুস সামাদ তালুকদার
আরও পড়ুন : রক্ত স্রোতে পবিত্র হয়ে জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতির স্বাধীন বাসভূমি বাংলাদেশ : ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ
আরও পড়ুন : আমাদের মতো মানুষের কাছে একাত্তরের স্মৃতি বিবিধ : আফসান চৌধুরী
আরও পড়ুন : একদিকে বিজয়ের উল্লাস, অন্যদিকে প্রিয় দুই শিক্ষকের মৃত্যু আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল : ডা. মাগদুমা নার্গিস রত্না
আরও পড়ুন : রেডিওতে পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর শুনে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই : সাইফুল ইসলাম
লালসবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা