ফজলুল বারী ঃ কোভিড নাইনটিন তথা করোনা ভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের ডাক্তাররা নিরাপত্তার দাবি তুলেছেন। কর্ম বিরতি পালন করেছেন ইন্টার্নি ডাক্তাররা। যৌক্তিক দাবি। এরসঙ্গে নার্স সহ স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক-পুলিশ সহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সংযু্ক্ত করতে হবে। যে কোন রোগের মতো করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ডাক্তারদের সঙ্গে নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ওতোপ্রোত জড়িত। করোনায় এখন পর্যন্ত ইতালিতে যত লোক আক্রান্ত এবং মারা গেছেন এর ৯ শতাংশ ডাক্তার-নার্স এবং স্বাস্থ্য কর্মী। কাজেই বাংলাদেশে ডাক্তাররা যে দাবি তুলেছেন তা অবজ্ঞার সুযোগ নেই।
সেই ডিসেম্বর থেকে করোনার থাবা মেলা শুরু হয় চীনে। এরপর থেকে দেশে দেশে এ নিয়ে নানান প্রস্তুতি শুরু হয়। বাংলাদেশেও এমন প্রস্তুতি-হাঁকডাক কম শোনা যায়নি। কিন্তু এতোদিন পর এসে কেনো শুনতে হলো বাংলাদেশের ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত পিপিই’ই কেনো নেই! আমাদের সরকারি কর্তৃপক্ষ কেমন তা আমরা জানি। সিটিং দিয়ে মিটিং করে সব কথা জানতে হয়। সেখানে কার কী করতে হবে শুনতে হয়। এরপর অমুককে লেখা, অমুককে দেখা, চিঠি চালাচালি এসব করতে করতেই দিন যায়। সবশেষে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসি গণভবনের দিকে! দেখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী বলেন! এভাবে অপেক্ষা অথবা সরকারকে দোষ দেয়া অথবা গালি দেয়া আমাদের মুখস্ত স্বভাব।
কিন্তু ডাক্তার সাহেবদের বলি, আপনাদের যে সব সংগঠন আছে, এই সংগঠনগুলোর আসলে কাজ কী? এরশাদ আমল পর্যন্ত বিএমএ ছিল ডাক্তারদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন। এখন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সংগঠন স্বাচিপ অথবা ড্যাব, বিএমএ’র চেয়ে বেশি শক্তি অথবা প্রভাবশালী! নার্সদেরও এমন প্রভাবশালী দলীয় সংগঠন আছে। সরকার দলীয় ডাক্তার-নার্সদের পোষ্টিং-বদলি-বিদেশ সফরে ভূমিকা রাখাই বা তেল মারাই কী এসব সংগঠনের একমাত্র কাজ? আর ড্যাবের কাজ শুধু বিএনপি নেতাদের তাবেদারি করা? করোনা ভাইরাস নিয়ে ডাক্তার-নার্সদের সুরক্ষার জন্যে এসব সংগঠন শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কী কী কাজ করেছে? অশ্বডিম্ব।
ডাক্তারদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত পিপিই নাই জেনে এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে বেশিকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এগুলোর তরুন উদ্যোক্তারা নানাজনের সাহায্য সহায়তা নিয়ে পিপিই সহ নানাকিছু প্রস্তুত করে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সহ এমন কিছু সংগঠন এ ব্যাপারে কাজ করছে। কিন্তু ডাক্তাদের সংগঠনগুলো এমন কিছু করছে কী? ধনাঢ্য ডাক্তার আমাদের দেশে কম নয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের হাতের মুঠোয়। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা লোকজনের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিয়ে এসব পিপিই সহ নানাকিছুর ব্যবস্থা করে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, ডাক্তারদের সংগঠন-ধনাঢ্য ডাক্তাররা কী তা করতে পারতেন? প্রশ্নটি রেখে গেলাম।
করোনা ভাইরাসকে ঘিরে দেশে দেশে বিশেষ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সে সব দেশের ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নানা মানবিক ভূমিকার গৌরব কাহিনী বেরুচ্ছে। দিন শেষে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন বা দেবেন আমাদের ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরাই। কাজেই তাদের কারো কোন ভূমিকা যেন তাদের অবদান কোন আড়াল বা প্রশ্নের মুখে না পড়ে। সরকার যে এরমাঝে পিপিই সহ নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবস্থা করেছে, আরও আনছে এগুলোর যেন যথাযথ বিলিবন্টন ও ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশে এরমাঝে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সমন্বয়ের অভাব সহ নানা অভিযোগ আসছে। অনেক হাসপাতাল এমন রোগীই ভর্তি করতে রাজি হচ্ছেনা। গত দশ-বার বছরে বাংলাদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষখাতে বিপুল বেসরকারী বিনিয়োগ হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক হাসপাতাল। এগুলোর মালিকদের সিংহভাগ সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত। কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে এগুলোর উদ্যোগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পতাকা নাড়া, ছবি তোলা, টেলিভিশনে মোটা মোটা ঘাড়ওয়ালা মুখগুলো দেখানোও হয়েছে। কিন্তু এগুলোর সিংহভাগ যে চামার শ্রেনীর, বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার চেতনাকে এরা যে ধারন করেনা, সম্ভাব্য করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অনীহা এর প্রমান। এদের সবাইকে বলবো মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর এটাই সুযোগ। মানুষের পক্ষে দাঁড়ালে আখেরে কিন্তু আপনাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম-ব্যবসাও বাড়বে।
করোনা আতঙ্ক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর কিছু ছবি দেখে মনে হলো এ অবস্থায় কে কিভাবে নিরাপদে থাকবেন তা নিয়ে পুলিশ ও অনেকেরই ধারনার অভাব রয়েছে। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ছাড়াও এ মূহুর্তে যে কোন জায়গায় দাঁড়াতে বা কাজ করার সময় সোশ্যাল ডিসটেন্স গুরুত্বপূর্ন। অস্ট্রেলিয়ায় এই দূরত্বের পরামর্শ দেয়া হয়েছে চার বর্গ মিটার। পরষ্পরের দাঁড়ানোর দূরত্ব হবে চার বর্গ মিটার। অস্ট্রেলিয়ায় যে মসজিদ-গির্জা বন্ধ করা হয়েছে কারন এগুলোয় যারা যান তারা পরষ্পরের সঙ্গে চার মিটার ব্যবধান মানেননা বা মানবেননা। এতে করে একজন থেকে আরেকজনে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় সব রেষ্টুরেন্ট-বার-নাইট ক্লাহ-ক্যাসিনো বন্ধ করা হয়েছে, জিম বন্ধ করা হয়েছে, কারন এগুলোর মাধ্যমে ঘটতে পারে রোগটির সামাজিক সংক্রমন।
কিন্তু বাংলাদেশে বিদেশ থেকে যাওয়া লোকজন বিয়ে বাড়িতে মসজিদে গিয়ে রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে! এর বড় একটি কারন সে তার পারসোনাল প্রটেকশন-নিরাপত্তাই জানেনা। আরেকজনকে নিরাপদ করবে কি করে! বাংলাদেশের টেলিভিশনে দেখলাম পুলিশ কোয়ারিন্টানে থাকা মানুষকে খাবার দিচ্ছে এটি প্রচারের জন্যে টেলিভিশনের সাংবাদিক ম্যানেজ করেছে! চট্টগামের কোতোয়ালি থানা থেকে বেরুবার সরু পথের ওখানে পুলিশের এক সদস্য দাঁড়িয়ে খাবার হাতে পুলিশের সদস্যদের বের করে দিচ্ছেন! সেখান থেকে ক্যামেরা হাতে বেরুচ্ছেন সাংবাদিকরা! কারো সঙ্গে কারো নিরাপদ দূরত্ব নেই! আইইডিসিআর সোমবার অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন শুরু করেছে! সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্যে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ওই প্যানেলে আইইডিসিআর এর পরিচালক সেব্রিনা সহ তিনজন যেভাবে বসেছেন তাতে পরষ্পরের নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করেননি।
এখন পরিস্থিতির কারনে ডাক্তার সহ নানা শ্রেনীপেশার মানুষজন ব্যক্তি নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হলেও ব্যক্তি নিরাপত্তার ব্যাপারে সবচেয়ে উদাসীনভাবে কাজ করছেন সাংবাদিকরা। টেলিভিশনে পিটিসি দেবার সময় শুধু একটা মাস্ক মুখে পরলে বা গলায় ঝুলালেই নিরাপত্তা হয়নারে ভাই। সাবজেক্টের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব না মেনে উদাসীনভাবে চলা কোন একজন সাংবাদিক যদি এরকারনে আক্রান্ত হন তাতে তা সাংবাদিক কমিউনিটিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অতএব সাধু সাবধান।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা