দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর ‘প্রতিরোধ, শিক্ষা ও আউটরিচ কার্যক্রম’ সন্তোষজনক হলেও ‘অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরর’ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।
মঙ্গলবার ( ২৫ ফেব্রুয়ারি) ‘দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ উদ্যোগ: বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর একটি ফলো-আপ গবেষণা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে একথা জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে টিআইবি।
টিআইবি, বলেছে, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা, কাজের আওতা, আইনি স্বাধীনতার পাশপাশি কমিশনারদের নিয়োগ ও অপসারণ; এবং আর্থিক ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রে বাজেটের পর্যাপ্ততা থাকাসহ দুদকের বেশকিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। এরপরও জাতীয় বাজেটের তুলনায় অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকা, অভিযোগকারীরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশে অনাগ্রহী, যা দুদকের প্রতি তাদের আস্থাহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতা বোধের নির্দেশক। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগের সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে দুদকের দুর্বলতা, অভিযোগের তুলনায় মামলা দায়েরের হার কম এবং নারী ও দরিদ্রসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশেষ চাহিদা মেটানোর কোনো ধরনের কাঠামোগত সুবিধার অনুপস্থিতি থাকায় দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ধারণা খুব আশাব্যঞ্জক নয়, যা সংস্থাটির প্রতি আস্থাহীনতাকেই নির্দেশ করে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম।
গবেষণার মূল্যায়ন অনুযায়ী বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের সার্বিক স্কোর ৬০ শতাংশ যা ‘মধ্যম’ পর্যায়ের নির্দেশ করে, যা ‘উচ্চ’ পর্যায় থেকে ৭ পয়েন্ট কম গবেষণা অনুযায়ী দুদক ৫০টি নির্দেশকের মধ্যে মোট ২১টি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ‘উচ্চ’, ১৮টি ক্ষেত্রে ‘মধ্যম’ এবং ১১ নির্দেশকের ক্ষেত্রে ‘নিম্ন’ স্কোর করেছে। দুদকের ‘প্রতিরোধ, শিক্ষা ও আউটরিচ কার্যক্রম’ বিবেচ্য ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করেছে (৭৫ ভাগ), ‘স্বাধীনতা ও মর্যাদা’ ৬৭ শতাংশ এবং ‘সহযোগিতা ও বাহ্যিক সম্পর্ক’ ৬৭ শতাংশ স্কোর পেয়েছে। অপরদিকে ‘অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের’ ৪৪ শতাংশ অর্থ্যাৎ সবচেয়ে কম স্কোর পেয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্নীতি দমনমূলক কার্যক্রমে দুদক পিছিয়ে আছে।
সার্বিকভাবে দুদকের কার্যকরতার মাপকাঠিতে কোনো বিশেষ অগ্রগতি হয়নি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের মূল ম্যান্ডেড দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখা, আইনের চোখে সকলেই সমান এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে, নিরপেক্ষভাবে সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত হয়ে তার দায়িত্ব পালনের যে সৎ সাহস ও দৃঢ়তা, অন্যদিক থেকে রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য, এই উভয় দিকেই ঘাটতি দৃশ্যমান। কর্মী নিয়োগ ও প্রচার-প্রচারণার মতো কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি হয়েছে। তবে, দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরের মতো মৌলিক ক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রতিবেদন অনুযায়ী দুদকের জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচারের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাহ্যিক কোনো সার্বিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকা। যদিও নিয়মিতভাবে তদন্ত প্রতিবেদন মূল্যায়নের জন্য দুদকের নিজস্ব তদারকি ও মূল্যায়ন শাখা রয়েছে, কিন্তু এই কাঠামোতে জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোনো ব্যবস্থা নেই। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনের ওপর সংসদে কোনো আলোচনা হয়না। ২০১৯ সালে প্রণীত দুদক কর্মীর আচরণ ও শৃঙ্খলাজনিত একটি খসড়া তৈরি হয়েছে, যা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। দুদকের ইন্টারনাল করাপশন প্রিভেনশন কমিটি দুদকের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করে থাকে, তবে এক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাতের ঝুঁকিসহ দুদকের কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলারও অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের সাড়া প্রদানের হার কম হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে দুদকের অভিযোগ বাছাই ব্যবস্থা। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে মোট ৪৭ হাজার ৫ শত ৪৯টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ২ শত ৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় যা (৬.৭৫%) আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে এটি ৬৬ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা। তবে দুদকের মতে অধিকাংশ অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না। অপরদিকে, গত কয়েক বছরে দুদকের দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ার হার গড়ে ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশ হলেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের থেকে (৭৫ ভাগ বেশি) কম।
গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর বাস্তব সমাধানের লক্ষ্যে টিআইবি ষোল দফা সুপারিশ প্রদান করেছে। দুদকের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট আইন (দুদক আইন ২০০৪, অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮) সংশোধনসহ দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা, অর্থপাচার ও ব্যক্তিমালিকানাসহ বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকে দুদকের কাজের আওতাভুক্ত করা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য দুদকের সুপারিশকে বাধ্যতামূলক করা; অনুমোদিত অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ, অনুসন্ধান ও তদন্ত ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে কর্মী সংখ্যা বাড়াতে হবে; যারা তদন্ত, মামলা পরিচালনা ও প্রতিরোধের কাজে জড়িত তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে; দুর্নীতির মামলার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া অনুসরণ, দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সমন্বিত ও বিশেষায়িত আচরণ বিধি প্রণয়ন; অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানের সংখ্যা বাড়ানোসহ কী মাপকাঠিতে অভিযোগ গ্রহণ করা হলো না তার ব্যাখ্যা প্রকাশ করা এবং দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে সঠিক অনুসন্ধান পরিচালনা ও মামলা দায়েরের পূর্বে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করাসহ মোট ১৬টি সুপারিশ জানিয়েছে টিআইবি।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা